Skip to main content

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র আপাত সমঝোতার নেপথ্যে

শাহনেওয়াজ খান



সম্প্রতি ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধিকরণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির একটি আপাত সমঝোতা হয়েছে। আপাত বললাম এ কারণে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই অদূর ভবিষ্যতে এ চুক্তির মূল্যায়ন করবে কিনা তা দেখার বিষয়। আর ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতা বলার কারণ, চুক্তিটি বিশ্বশক্তিগুলোর সঙ্গে হলেও মূলত তা ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তি। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি- বর্তমান সময়ের মহাপরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিলেও অবশেষে তা থেকে সরে এসেছে। এর আগে এর চেয়েও ঠুনকো অভিযোগে আফগানিস্তান ও ইরাকে হামলা চালালেও ইরানের ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় মনোভাব বিশ্ববাসীকে বেশ অবাকই করেছে। তবে এর পেছনেও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণগুলোকে আমি দু’ভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে চাই।

১. যেটা সকলেই কম-বেশি অনুধাবন করেছেন ও বলেছেন তা হলো অর্থনৈতিক কারণ। একে তো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বর্তমানে বেশ সুবিধাজনক স্থানে নেই, তার ওপর আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের ব্যয় বেশ সংকটেই ফেলেছে তাদের। এছাড়া সিরিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহীদের অর্থনৈতিক ও যুদ্ধাস্ত্র সাহায্য অব্যাহত থাকায় বেশ কিছুটা চাপও সামলাতে হচ্ছে তাদের। ঠিক এ মুহূর্তে ইরানের মতো দেশে হামলা দেশটির জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণই। সত্যি বলতে, দীর্ঘমেয়াদী ও ব্যয়বহুল এ হামলাটি তাদের জন্য ঠিক কতটা সুফল বয়ে আনবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র ঠিক এ মুহূর্তে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চাচ্ছে না। একই সঙ্গে মুরুব্বিয়ানাও বজায় রাখতে হয়! তাই এ সমঝোতা চুক্তি।

২. প্রথম কারণটি ছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে চাই, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া ছাড়া বিশ্বের অন্য কোনো দেশের পক্ষে একক সামরিক যুদ্ধ চালিয়ে রাখা সম্ভব নয়; তাই দেশটির সঙ্গে যুদ্ধ এড়াতে হলে চাই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থান ও কূটনৈতিক কৌশল। ইরান বিষয়টি অনুধাবন করে ঠিক এ পথেই এগিয়েছে।

আগেই দেখিয়েছি যুক্তরাষ্ট্র ঠিক এ মুহূর্তে ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার মতো সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। এজন্য তারা ইরানের ওপর প্রথমে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তাদের মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে এ অবরোধ আরোপ করলেও রাশিয়া, চীন বরাবরই এর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের বাণিজ্য বন্ধ হলেও এ ব্লকটিতে তা বেশ ভালোভাবেই বজায় ছিল। এ কারণে ইরানকে খুব একটা বেগ পোহাতে হয়নি। কারণ, ইসলামী বিপ্লবের পর থেকেই দেশটি পশ্চিমাদের সঙ্গে বাণিজ্য বেশ কমিয়ে এনেছিল।

তবে অবরোধ আরোপর বেশ কিছুদিন পর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বেশ কমে যায়। এর ফলে ইরানের অর্থনীতি বেশ হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল। কিন্তু, সকলকে চমকে দিয়ে এ অবস্থা থেকে উৎরে যায় দেশটি। রাশিয়া ও চীনের পাশাপাশি এ সময় আগমন ঘটে এশিয়ার আরেক পরাশক্তি ভারতের। অনেকটা রাজনৈতিকভাবে উল্টো মেরুতে অবস্থান করা দেশ দুটির মধ্যকার তেল চুক্তিতে বেশ অবাকই হয় বিশ্বশক্তিগুলো। পশ্চিমা দেশগুলো সরাসরি ভারতকে এ চুক্তি থেকে সরে আসতে বললেও এতে সাড়া দেয়নি দেশটি। এ চুক্তির ফলে অর্থনৈতিক অবরোধের মাঝেই অর্থনৈতিক সীমানা বাড়ায় ইরান। এছাড়া জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে দেশটির তেল বাণিজ্য আগে থেকেই চলে আসছে।

রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে এ চুক্তি বেশ গুরুত্ব বহন করে। এতে একটি প্রশ্ন স্বভাবতই দেখা দেয়- সত্যিই কি অবরোধ আরোপের ফলে তেলের মূল্য কমেছিল না ইচ্ছাকৃতভাবেই কমিয়েছিল ইরান? তেলের মূল্য হ্রাসের পরপরই কিন্তু ইরানের তেল বাণিজ্য আরেকটু চাঙ্গা ও বিস্তৃত হলো। কিছুদিন পর তেলের মূল্য কিন্তু ঠিকই আগের স্থানে ফিরে এসেছিল!

একটা বিষয় স্পষ্ট যে, বর্তমান যুদ্ধের উদ্দেশ্য শুধু প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করাই নয়; উপরন্তু অর্থনৈতিকভাবেও লাভবান হওয়া। সেক্ষেত্রে বর্তমানে একক যুদ্ধ পরিচালনা বেশ অসাধ্যই। একজন লাভবান হবে, আর অন্য মোড়লরা তা তাকিয়ে দেখবে তা হতে পারে না। এজন্যই সাম্প্রতিক যুদ্ধগুলোতে ইউরোপীয় দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপীয় মিত্ররা এগুলো থেকে লাভবান হলেও রাশিয়া ও চীন কিন্তু সরাসরি তা হয়নি। এ কারণে তারা প্রত্যেক যুদ্ধেই ভেটো দিয়েছে। এবার ইরান যখন তাদের কম মূল্যে তেল সরবরাহ করছে তখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য খামোখা তারা তা ত্যাগ করবে কেন? অল্পমূল্যে তেল পাওয়া যুদ্ধ করে তা কেড়ে নেওয়ার চেয়ে অধিক সুবিধাজনক। সুতরাং, এ সুযোগ কেন হাতছাড়া করবে তারা? তাই এবার শুধু ভেটো দানেই সীমাবদ্ধ না থেকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করল দেশ দুটো। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক কারণেই রাশিয়াকে একটু জোরালো ভূমিকা রাখতে হয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের আগে থেকেই মোড়লগিরির একটা ঠাণ্ডা লড়াই চলে আসছে। এবার একটা যুৎসই প্লাটফর্মও পেয়ে গেল দেশটি। পাশাপাশি নতুন করে ভারত যোগ দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিষয়টি বেশ চ্যালেঞ্জই ছুঁড়ে দেয়।

এ অবস্থায় মধ্যপন্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক আলোচনাকেই বেছে নেয়। শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের এ আলোচনার ফলে আপাতত একটা যুদ্ধ এড়াল বিশ্ব। তবে ইসরাইলের অসন্তুষ্টি ও ভ্রুকূটি কিছুটা অস্বস্তি রেখেই দিল। শক্তিশালী ইহুদি লবিকে যুক্তরাষ্ট্র কতটা উপেক্ষা করতে পারবে সেটাই দেখার বিষয়।

Comments

Popular posts from this blog

হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন না সম্রাট আওরঙ্গজেব

নিউজ এক্সপ্রেস ডেস্ক: মুঘল সম্রাটদের মধ্যে কেবল একজনই ভারতীয়দের মধ্যে স্থান করে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন - তিনি আলমগীর আওরঙ্গজেব। সাধারণ মানুষের মধ্যে আওরঙ্গজেবের ইমেজ হলো একজন ধর্মীয় গোঁড়া ব্যক্তি হিসেবে , যিনি হিন্দুদের ঘৃণা করতেন আর যিনি নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে এমনকি নিজের বড় ভাই দারা শিকোকে পর্যন্ত রেহাই দেননি। তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি বৃদ্ধ পিতাকে আগ্রার একটি দুর্গে তার জীবনের শেষ সাড়ে সাত বছর বন্দি করে রেখেছিলেন। সম্প্রতি পাকিস্তানী নাট্যকার শাহীদ নাদিম লিখেছেন যে ভারত ভাগের বীজ সত্যিকার অর্থে সেদিনই বপন করা হয়েছিল , যেদিন আওরঙ্গজেব তার ভাই দারাকে পরাজিত করেছিলেন। জওহরলাল নেহরুও ১৯৪৬ সালের প্রকাশিত তার বই ‘ ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া ’ তে আওরঙ্গজেবকে একজন গোঁড়া ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তবে মার্কিন ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রাশকা তার বই ‘ আওরঙ্গজেব - দ্যা ম্যান অ্যান্ড দ্যা মিথ ’ বইয়ে লিখেছেন যে আওরঙ্গজেব হিন্দুদের ঘৃণা করতেন আর তাই মন্দির ধ্বংস কর

দাঁড়িয়ে পানি পান কি ঠিক?

নিউজ এক্সপ্রেস ডেস্ক : সময় কিংবা অভ্যাসের কারণে আমরা অনেকেই দাঁড়িয়ে পানি পান করি। কিন্তু এই অভ্যাসের মাধ্যমে আমরা ডেকে আনছি বিপদ। একটা নয়, একগুচ্ছ রোগ বাসা বাঁধছে শরীরে। ভুগতে হচ্ছে কিডনি সমস্যায়। শরীরে পানির গুরুত্ব অনেক। কিন্তু ভুল নিয়মে পানি, বিশেষ করে রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে ঢকঢক করে পানি পানের অভ্যাসে শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রোগ- এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। দাঁড়িয়ে পানি পানের কুফল শরীরে টক্সিনের পরিমাণ বাড়ে: পানি পানের পরেই শরীরের ছাঁকনিগুলো শরীরকে পরিশ্রুত করার কাজ শুরু করে। দাঁড়িয়ে পানি পান করলে শরীরের ভিতরে থাকা ছাঁকনিগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। পরিশ্রুত করার কাজ বাধা পায়। ফলে, শরীরে টক্সিনের মাত্রা বাড়তে থাকে। পাকস্থলীতে ক্ষত: দাঁড়িয়ে পানি পান করলে তা সরাসরি পাকস্থলীতে গিয়ে আঘাত করে। পাকস্থলী থেকে নিঃসৃত অ্যাসিডের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বদহজমের আশঙ্কা বাড়ে। তলপেটে যন্ত্রণাসহ একাধিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। আর্থারাইটিসের আশঙ্কা: দাঁড়িয়ে পানি পান করলে শরীরের মধ্যে থাকা কিছু উপকারী রাসায়নিকের মাত্রা কমতে থাকে। ফলে হাড়ের জোড়ায় কর্মক্ষমতা কমে যায়। সেখান থেকে আর্থারাইটিসের আশ

হরিণের রাজ্যে

শাহনেওয়াজ খান আমরা দশ-বারোজন মিলে চারদিক থেকে ঘিরে ধরলাম হরিণের পালটাকে। ৬০-৭০টা হরিণ হবে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে পালটাকে ঘিরে ধরেছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আলো দ্রুত কমে যাচ্ছে। শেষ সময়, সুতরাং সবাই চারদিক দিয়ে এক নিঃশ্বাসে দৌড় দিলাম হরিণের পালকে আটকাতে। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য! আমার দু’পাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে হরিণ। এত জোরে দৌড়াচ্ছে যে পায়ের নিচের খুড়ের অংশগুলো ঠিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। হরিণের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ার ইচ্ছেটা শুরুতেই তো বড় বড় শিং দেখে মারা গিয়েছিল। এখন দৌড় দেখে উল্টো চুপসে গেলাম। মনে মনে প্রার্থনা শুরু করলাম, হে আল্লাহ, শিং বা খুরের আঁচড় যেন গায়ে না লাগে। বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে, এটা সুন্দরবন বা বিদেশি কোনো সাফারি পার্কের দৃশ্য? না, এটা আমাদের গর্ব নিঝুম দ্বীপের গল্প। খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলোর দ্বীপে যেখানে হরিণই চাঞ্চল্যের উৎস। তবে এই হরিণগুলো কিন্তু শুধু দ্বীপের পরিবেশকেই নয়, মানুষগুলোকেও ব্যস্ত রাখে। দল বেধে এসে নষ্ট করে দেয় ক্ষেতের ফসল। ২০০৯ সালের শুরুর দিকে শীত মৌসুমে গিয়েছিলাম নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স