Skip to main content

হিন্দু করসেবকরা বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার মহড়া দিয়েছিল


নিউজ এক্সপ্রেস ডেস্ক : ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের অযোধ্যা শহরে সপ্তদশ শতকে তৈরি ঐতিহাসিক স্থাপনা বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলেছিল উন্মত্ত হিন্দু জনতা। এ ঘটনার পর ভারতে ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হয় প্রায় দুই হাজার মানুষ (বেসরাকরি সংস্থাগুলোর হিসাবমতে কয়েক হাজার)। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রস্তুতি চলছিল আগে থেকেই এবং ঘটনার আগের দিন একদল হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক এটির ‘ড্রেস রিহার্সেল’ দিয়েছিল। আলোকচিত্র সাংবাদিক প্রভীন জৈন ছবি তোলার জন্য এই হিন্দু স্বেচ্ছাসেবকদের অনুসরণ করছিলেন। সেদিনের ঘটনার অনেক ছবিও তুলেছেন তিনি। প্রভীন জৈন বিবিসির কাছে বর্ণনা করেছেন সেদিনের ঘটনাবলী-

আমি অযোধ্যা এসে পৌঁছাই ১৯৯২ সালের ৪ ডিসেম্বর। সেই সন্ধ্যায় অযোধ্যা ছিল কুয়াশাচ্ছন্ন। আমি তখন ‘দ্য পাইওনিয়ার’ পত্রিকায় কাজ করি। তারা আমাকে এই অ্যাসাইনমেন্টে পাঠিয়েছে। হিন্দু করসেবক এবং উগ্রপন্থী হিন্দু নেতাদের যে দলটি বাবরি মসজিদ চত্ব্বরে সমবেত হবে, আমাকে তাদের ছবি তুলতে হবে।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) হাজার হাজার কর্মী তখন সেখানে জড়ো হয়েছে। এই দলটি ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা। ভারতে যে সব হিন্দু দল এবং গোষ্ঠী সক্রিয়, তাদের আদর্শগত নেতৃত্বে আছে এই আরএসএস। এসব দলের মধ্যে আছে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপিও, যারা এখন ভারতের শাসনক্ষমতায়।

হিন্দু গোষ্ঠীগুলো মনে করে বাবরি মসজিদ যেখানটায় তৈরি করা হয়েছে, সেটি আসলে হিন্দু দেবতা রামের জন্মভূমি। মসজিদের কাছে তারা একটি হিন্দু মন্দির তৈরির পরিকল্পনা করছিল। হিন্দু নেতারা আশ্বাস দিয়েছিলেন তারা মসজিদ স্পর্শ করবেন না। আর তাদের কর্মসূচি মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং সেখানে একটি ধর্মীয় প্রার্থনা আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

একজন বিজেপি এমপির সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, ৫ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার একটা মহড়া হবে। তিনি আমাকে আরো জানিয়েছিলেন, শীর্ষ নেতারা তাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন এই মহড়ায় যেন সাংবাদিকরা কোনভাবেই হাজির থাকতে না পারে। তিনি আমাকে বললেন,“তবে আপনি আমার বন্ধু এবং আমি আপনাকে বন্ধু হিসেবে এই তথ্যটা দিলাম।”


আমি তখন ছদ্মবেশে এই হিন্দু করসেবকদের সঙ্গে মিশে গেলাম। আমার মাথায় পট্টি বাঁধা, গায়ে গেরুয়া রঙের স্কার্ফ। জ্যাকেটের গায়ে সাঁটা একটা ব্যাজ, যা দেখে সবাইকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হবে। মসজিদের অল্প দূরেই একটা ফুটবল মাঠের সমান একটা জায়গায় সবাই জড়ো হচ্ছিল। আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। হাজার হাজার মানুষ তখন সেখানে জড়ো হয়েছে যাদের সবার মাথায় পট্টি বাঁধা এবং গায়ে গেরুয়া বসন। ব্যাজ পরা হিন্দু করসেবকরা পুরো জায়গাটি ঘিরে রেখেছে।

যে আমাকে সেখানে ঢুকতে সাহায্য করেছিল, সে আমাকে বলেছিল, একমাত্র এভাবেই আপনি এই মহড়ার ছবি তুলতে পারবেন। “আমার কাছাকাছি থাকুন, অন্য করসেবকদের মতো শ্লোগান দিন, ওদের সঙ্গে মিশে যান। এতে করে আপনি নিরাপদও থাকবেন।”

তবে আমি হঠাৎ দেখলাম একটা মোটাসোটা লোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার ক্যামেরা বন্ধ করতে বলছে। আমি আমার বুকে লাগানো ব্যাজ দেখিয়ে আর সবার মতো জোরে জোরে শ্লোগান দিতে থাকলাম। তখন লোকটি মাথা ঝাঁকিয়ে দূরে দাঁড়ানো একদল মানুষের কাছে যেতে ইঙ্গিত করলো।

কিন্তু আমি আমার ক্যামেরায় ছবি তুলতে শুরু করলাম। আমার সামনে তখন অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটে চলেছে। শাবল, কুড়াল, বেলচা এবং লোহার রড নিয়ে তখন লোকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তারা এক বিরাট মাটির ঢিবি ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করছে।

সবকিছুই ঘটছিল খুব পরিকল্পিত এবং সুচারুভাবে। এদের দেখে মনে হচ্ছিল না তারা কেবল স্বেচ্ছাসেবক, যেভাবে পেশাদারী কায়দায় তারা কাজ করছিল তাতে মনে হচ্ছিল কিভাবে একটা বিল্ডিং ভেঙ্গে ফেলতে হবে সেটা তারা ভালোভাবেই জানে।

ভারত সরকারের নিয়োগ করা যে লিবারহান কমিশন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা তদন্ত করেছিল, ২০০৯ সালে তারা তাদের রিপোর্টে এই মহড়ার কথা উল্লেখ করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, “কমিশনের কাছে এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে বিতর্কিত এই কাঠামোটি ভেঙ্গে ফেলার জন্য একটি মহড়া দেওয়া হয়েছিল। কমিশনের কাছে এর কিছু ছবিও জমা পড়েছে। তবে এটি ভাঙ্গার জন্য কোন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল কিনা, তার নিশ্চিত প্রমাণ নেই। যদিও কিছু অবস্থাগত প্রমাণ এবং কিছু সাক্ষ্য থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে করসেবকদের এটি ভাঙ্গার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল।”

আমি একটা লোকের ছবি তুলেছিলাম, যার মুখ রুমালে ঢাকা ছিল। সবার মধ্যে একমাত্র সেই তার মুখটি আড়াল করে রেখেছিল। মাটির ঢিবিটা যারা ধ্বংস করে সরিয়ে নিচ্ছিল, লোকটি চিৎকার করে তাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিল। একটি ডানপন্থী হিন্দু গোষ্ঠীর নেতা গোছের বলে মনে হচ্ছিল তাকে। সেজন্যেই সে তার পরিচয় প্রকাশ করতে চাইছিল না। মাটির ঢিবিটা শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে ফেলা হলো। হিন্দু করসেবকরা এরপর সোল্লাসে চিৎকার করতে লাগলো।

আমি জ্যাকেটের মধ্যে আমার ক্যামেরা লুকিয়ে ফেললাম এবং সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। আমি তখনো লোকজনের সঙ্গে শ্লোগান দিচ্ছিলাম। কিন্তু আমার ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল। আমিই হচ্ছি একমাত্র আলোকচিত্র সাংবাদিক, যে এই ঘটনার ছবি তুলতে পেরেছি।

পরের দিন বাবরি মসজিদের কাছেই একটি ভবনের চার তলায় আমরা সাংবাদিকরা অবস্থান নিয়েছিলাম। সেখান থেকে বাবরি মসজিদ দেখা যায়। সেখানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বিজেপির নেতারা যে সভামঞ্চ তৈরি করেছেন, সেটিও চোখে পড়ে। প্রায় দেড় লাখ হিন্দু করসেব সেখানে জড়ো হয়েছে।

সেখানে থাকা পুলিশ পর্যন্ত করসেবকদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে শ্লোগান দিচ্ছিল। দুপুরের একটু পর জনতা উন্মত্ত হয়ে উঠলো। যে পুলিশ বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবকরা মসজিদ ঘিরে রেখেছিল, তাদের বেষ্টনি ভেঙ্গে ফেললো জনতা।

কিছু লোক আমরা যে ভবনে ছিলাম, তার চার তলায় উঠে এলো। তারা সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালালো। ক্যামেরা ভেঙ্গে ফেললো। কয়েক মিটার দূরেই যে মসজিদ ভাঙ্গার কাজ চলছে, সেটার কোন ‘ফটোগ্রাফিক’ প্রমাণ যেন না থাকে। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হলো বাবরি মসজিদ।

আমি দৌড়াতে দৌড়াতে আমার হোটেলে ফিরে এলাম। ততক্ষণে দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। আমি চারিদিকে পুলিশের সন্ধান করছিলাম, যারা সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু লোকজন তখন দোকান বন্ধ করছে, বাড়ির দরজায় খিল দিচ্ছে। জানালা বন্ধ করছে।

যেদিন এভাবে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হলো, একজন হিন্দু হয়ে আমি সেদিন লজ্জিত বোধ করছিলাম। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা তদন্ত করে যে ‘লিবারহান কমিশন’ তার সামনে আমি সাক্ষ্য দিয়েছিলাম। এই মামলার শুনানি চলছে যে বিশেষ আদালতে, সেখানে এখনো মাঝে মধ্যে আমাকে ডেকে পাঠায় সেন্ট্রাল ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (সিবিআই)। ২৫ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু এই ঘটনা যারা ঘটিয়েছিল, এখনো পর্যন্ত তাদের কারো সাজা হয়নি।

(প্রভীন জৈন এখন ভারতের ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ পত্রিকার এসোসিয়েট ফটো এডিটর। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বিবিসির অনসুয়া বসু।)

(এসকে/ডিসেম্বর ০৫, ২০১৭)

Comments

Popular posts from this blog

হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন না সম্রাট আওরঙ্গজেব

নিউজ এক্সপ্রেস ডেস্ক: মুঘল সম্রাটদের মধ্যে কেবল একজনই ভারতীয়দের মধ্যে স্থান করে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন - তিনি আলমগীর আওরঙ্গজেব। সাধারণ মানুষের মধ্যে আওরঙ্গজেবের ইমেজ হলো একজন ধর্মীয় গোঁড়া ব্যক্তি হিসেবে , যিনি হিন্দুদের ঘৃণা করতেন আর যিনি নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে এমনকি নিজের বড় ভাই দারা শিকোকে পর্যন্ত রেহাই দেননি। তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি বৃদ্ধ পিতাকে আগ্রার একটি দুর্গে তার জীবনের শেষ সাড়ে সাত বছর বন্দি করে রেখেছিলেন। সম্প্রতি পাকিস্তানী নাট্যকার শাহীদ নাদিম লিখেছেন যে ভারত ভাগের বীজ সত্যিকার অর্থে সেদিনই বপন করা হয়েছিল , যেদিন আওরঙ্গজেব তার ভাই দারাকে পরাজিত করেছিলেন। জওহরলাল নেহরুও ১৯৪৬ সালের প্রকাশিত তার বই ‘ ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া ’ তে আওরঙ্গজেবকে একজন গোঁড়া ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তবে মার্কিন ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রাশকা তার বই ‘ আওরঙ্গজেব - দ্যা ম্যান অ্যান্ড দ্যা মিথ ’ বইয়ে লিখেছেন যে আওরঙ্গজেব হিন্দুদের ঘৃণা করতেন আর তাই মন্দির ধ্বংস কর

দাঁড়িয়ে পানি পান কি ঠিক?

নিউজ এক্সপ্রেস ডেস্ক : সময় কিংবা অভ্যাসের কারণে আমরা অনেকেই দাঁড়িয়ে পানি পান করি। কিন্তু এই অভ্যাসের মাধ্যমে আমরা ডেকে আনছি বিপদ। একটা নয়, একগুচ্ছ রোগ বাসা বাঁধছে শরীরে। ভুগতে হচ্ছে কিডনি সমস্যায়। শরীরে পানির গুরুত্ব অনেক। কিন্তু ভুল নিয়মে পানি, বিশেষ করে রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে ঢকঢক করে পানি পানের অভ্যাসে শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রোগ- এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। দাঁড়িয়ে পানি পানের কুফল শরীরে টক্সিনের পরিমাণ বাড়ে: পানি পানের পরেই শরীরের ছাঁকনিগুলো শরীরকে পরিশ্রুত করার কাজ শুরু করে। দাঁড়িয়ে পানি পান করলে শরীরের ভিতরে থাকা ছাঁকনিগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। পরিশ্রুত করার কাজ বাধা পায়। ফলে, শরীরে টক্সিনের মাত্রা বাড়তে থাকে। পাকস্থলীতে ক্ষত: দাঁড়িয়ে পানি পান করলে তা সরাসরি পাকস্থলীতে গিয়ে আঘাত করে। পাকস্থলী থেকে নিঃসৃত অ্যাসিডের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বদহজমের আশঙ্কা বাড়ে। তলপেটে যন্ত্রণাসহ একাধিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। আর্থারাইটিসের আশঙ্কা: দাঁড়িয়ে পানি পান করলে শরীরের মধ্যে থাকা কিছু উপকারী রাসায়নিকের মাত্রা কমতে থাকে। ফলে হাড়ের জোড়ায় কর্মক্ষমতা কমে যায়। সেখান থেকে আর্থারাইটিসের আশ

হরিণের রাজ্যে

শাহনেওয়াজ খান আমরা দশ-বারোজন মিলে চারদিক থেকে ঘিরে ধরলাম হরিণের পালটাকে। ৬০-৭০টা হরিণ হবে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে পালটাকে ঘিরে ধরেছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আলো দ্রুত কমে যাচ্ছে। শেষ সময়, সুতরাং সবাই চারদিক দিয়ে এক নিঃশ্বাসে দৌড় দিলাম হরিণের পালকে আটকাতে। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য! আমার দু’পাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে হরিণ। এত জোরে দৌড়াচ্ছে যে পায়ের নিচের খুড়ের অংশগুলো ঠিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। হরিণের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ার ইচ্ছেটা শুরুতেই তো বড় বড় শিং দেখে মারা গিয়েছিল। এখন দৌড় দেখে উল্টো চুপসে গেলাম। মনে মনে প্রার্থনা শুরু করলাম, হে আল্লাহ, শিং বা খুরের আঁচড় যেন গায়ে না লাগে। বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে, এটা সুন্দরবন বা বিদেশি কোনো সাফারি পার্কের দৃশ্য? না, এটা আমাদের গর্ব নিঝুম দ্বীপের গল্প। খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলোর দ্বীপে যেখানে হরিণই চাঞ্চল্যের উৎস। তবে এই হরিণগুলো কিন্তু শুধু দ্বীপের পরিবেশকেই নয়, মানুষগুলোকেও ব্যস্ত রাখে। দল বেধে এসে নষ্ট করে দেয় ক্ষেতের ফসল। ২০০৯ সালের শুরুর দিকে শীত মৌসুমে গিয়েছিলাম নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স