শাহনেওয়াজ খান
পহেলা বৈশাখ এলেই ইলিশ-পান্তা আর বাহারি রঙে সাজার ধুম পড়ে যায়। সারা দেশে যেভাবে ইলিশভাজা খাওয়ার ধুম পড়ে তাতে অনেকটা সংশয় জাগে এটা কি (ইলিশ খাওয়া) পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি না পরবর্তী উৎপাদন? চৈত্র-বৈশাখ (মার্চ-এপ্রিল) মাসে তো দেশজুড়ে ইলিশ পাওয়ার কথা নয়। কারণ ইলিশের প্রজনন মৌসুম আশ্বিন-কার্তিক (অক্টোবর-নভেম্বর)। মূলত ওই সময়ই ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে। এরপর অগ্রহায়ণ-পৌষে (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে। কিন্তু বর্তমানে বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার ধুম দেখে মনে হয় এ সময় হয়ত বাংলার খাল-বিলও ইলিশে ভরপুর থাকত!
মাঝে মাঝে ভাবি বৈশাখে ইলিশের খরা ও চড়া বাজারমূল্য দেখেও কি বাঙালির হুঁশ হয় না? সাংস্কৃতিক উৎসবের নামে ব্যবসায়ীরা রমরমা ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। শুধু কি ইলিশ, এখন তো বৈশাখের জন্য নির্দিষ্ট পোশাকও রয়েছে! সংস্কৃতি রক্ষার জন্য তো ওগুলো চাই। হায়, বাংলায় কি আগে শুধু সাদা রংয়ের পোশাক পড়ার হিড়িক ছিল! বরং এখনো গ্রামীণ মেলা উপলক্ষ্যে বাহারি রংয়ের পোশাক পরতে দেখা যায়।
এসব কার্যক্রমের কারণে নববর্ষ আজ শুধু আর বর্ষবরণ নয়, বিশাল এক কর্পোরেট বাণিজ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পহেলা বৈশাখের নামে চলছে উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত ভেজাল সংস্কৃতি আর রমরমা ব্যবসা। ভাত ভিজিয়ে পান্তা বানানো, নদী থেকে ধরে আনা ইলিশকে রাতারাতি মহামূল্য বানিয়ে আর নির্দিষ্ট রং ও ডিজাইনের পোশাক-পরিচ্ছেদ বিক্রির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিশাল অঙ্কের টাকা। দেশের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র জনগণের ওপর চেপে বসছে আরেকটি অযাচিত ব্যয়ের খাত। বিষয়টি নিয়ে নতুন প্রজন্মকে তাই ভাবার পাশাপাশি ইতিহাসের পাতায়ও কিছুটা চোখ বুলিয়ে নিতে হবে।
আসুন সংক্ষেপে বাংলা সন, মাস ও নববর্ষের ইতিহাসে চোখ বুলাই—
বঙ্গাব্দ, বাংলা সন বা বাংলা বর্ষপঞ্জি হল সৌর পঞ্জিকাভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সৌরদিন গণনা শুরু হয়। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে মোট ৩৬৫ দিন কয়েক ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়। এই সময়টাই এক সৌর বছর। গ্রেগরীয় সনের মতো বঙ্গাব্দেও মোট ১২ মাস। আকাশে সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে বঙ্গাব্দের মাসের হিসাব হয়ে থাকে।
বঙ্গাব্দ শুরু হয় পহেলা বৈশাখ বা বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে। বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে এ পর্যন্ত পাওয়া মতগুলোর মধ্যে তুলনামূলক নির্ভরযোগ্য মত হলো— ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকদের শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে সব কাজকর্ম পরিচালিত হতো। মূল হিজরী পঞ্জিকা চন্দ্র মাসের ওপর নির্ভরশীল। চন্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর চন্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। এ কারণে চন্দ্র বৎসরে ঋতুগুলো সবসময় একই মাস অনুযায়ী থাকে না। আর চাষাবাদ ও এ জাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এ জন্য মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে প্রচলিত হিজরী চন্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চন্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব দেন। ফতুল্লাহ শিরাজীর সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জির অনুকরণে ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। তবে তিনি ২৯ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহণের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরী সালের মুহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
মূলত সুষ্ঠুভাবে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন।
পরবর্তী সময়ে খাজনা আদায়ের এই সময়কাল নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। কারণ বৈশাখ হলো গ্রীষ্মকাল। কৃষিনির্ভর বাঙালিদের জন্য এ সময়ে খাজনা পরিশোধ করা বেশ কষ্টকর। এর চেয়ে বরং হেমন্তকালে খাজনা পরিশোধ করা সহজ। কারণ ওই সময় বাঙালির ঘরে ঘরে ফসল থাকে। ফসল বিক্রির মধ্য দিয়ে সবার হাতে টাকা-পয়সা আসে। ফলে খাজনা পরিশোধে সক্ষম হয় তারা। এ ছাড়া ওই সময় ফসল ঘরে থাকায় পড়ে পিঠা তৈরির ধুম। একই সঙ্গে নদীতে পাওয়া যায় ‘মাছের রাজা’ ইলিশ। তাই এক সময় অগ্রহায়ণ মাসকে কেন্দ্র করে খাজনা আদায়ের জন্য বর্ষ শুরু করা হতো বলে অভিমত দিয়েছেন অনেক ইতিহাসবিদ।
বর্ষবরণ
সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই বর্ষবরণ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন বছরের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পরের দিন ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হতো। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।
মাস ও ঋতু পরিচিতি
বঙ্গাব্দের ১২ মাসের নামকরণ করা হযেছে নক্ষত্রমণ্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এই নামগুলো নেওয়া হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকে। বাংলা মাসের নামগুলো হচ্ছে—
বৈশাখ - বিশাখা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
জ্যৈষ্ঠ - জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
আষাঢ় - উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া নক্ষত্রের নাম অনুসারে
শ্রাবণ - শ্রবণা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
ভাদ্র - উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম অনুসারে
আশ্বিন - অশ্বিনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে
কার্তিক - কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
অগ্রহায়ণ - মৃগশিরা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
পৌষ - পুষ্যা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
মাঘ - মঘা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
ফাল্গুন - উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে
চৈত্র - চিত্রা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
ঋতু
গ্রীষ্ম - বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ
বর্ষা - আষাঢ়, শ্রাবণ
শরৎ - ভাদ্র, আশ্বিন
হেমন্ত - কার্তিক, অগ্রহায়ণ
শীত - পৌষ, মাঘ
বসন্ত - ফাল্গুন, চৈত্র
বাংলা সন সংস্কার
বাংলা একাডেমি বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয় ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বাধীন কমিটি বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সাংস্কৃতিক জীবনে কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে নির্ণয় করে সেগুলো থেকে উত্তরণের প্রস্তাবনা দেয়। বাংলা সনের ব্যাপ্তি গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির মতোই ৩৬৫ দিনের। যদিও সেখানে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের পরিপূর্ণ সময়কেই যথাযথভাবে নেওয়া হয়েছে। এই প্রদক্ষিণের মোট সময় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড। এই ব্যবধান ঘোচাতে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির প্রতি চার বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করা হয়। ব্যতিক্রম হচ্ছে সে শতাব্দী যাকে ৪০০ দিয়ে ভাগ করা যায় না। জ্যোতির্বিজ্ঞান নির্ভর হলেও বাংলা সনে এই অতিরিক্ত দিনকে আত্মীকরণ করা হয়নি। বাংলা মাস অন্যান্য সনের মাসের মতোই বিভিন্ন পরিসরের হয়ে থাকে। এই সমস্যাগুলোকে দূর করার জন্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বাধীন কমিটি বাংলা একাডেমির কাছে কতগুলো প্রস্তাব পেশ করে। এগুলো হলো—
বছরের প্রথম পাঁচ মাস অর্থাৎ বৈশাখ থেকে ভাদ্র হবে ৩১ দিনের। বাকি মাসগুলো অর্থাৎ আশ্বিন থেকে চৈত্র হবে প্রতিটি ৩০ দিনের মাস। প্রতি চতুর্থ বছরের ফাল্গুন মাসে অতিরিক্ত একটি দিন যোগ করে তা হবে ৩১ দিনের। বাংলা একাডেমি সরকারিভাবে এই সংশোধিত বাংলা মাসের হিসাব গ্রহণ করে। ওদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এখনও পুরনো বাংলা সনের প্রচলনই রয়ে গেছে।
বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল বা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। আধুনিক বা প্রাচীন যে কোনো পঞ্জিকাতেই এই বিষয়ে মিল রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমি আধুনিক পঞ্জিকায় এই দিন নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।
বাংলা দিনপঞ্জির সঙ্গে হিজরী ও খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সন ঘড়ির হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে। ইংরেজি দিন শুর হয় মধ্যরাতে। ঐতিহ্যগতভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের (১৯৯৫) ১লা বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমি এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করে।
পহেলা বৈশাখ এলেই ইলিশ-পান্তা আর বাহারি রঙে সাজার ধুম পড়ে যায়। সারা দেশে যেভাবে ইলিশভাজা খাওয়ার ধুম পড়ে তাতে অনেকটা সংশয় জাগে এটা কি (ইলিশ খাওয়া) পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি না পরবর্তী উৎপাদন? চৈত্র-বৈশাখ (মার্চ-এপ্রিল) মাসে তো দেশজুড়ে ইলিশ পাওয়ার কথা নয়। কারণ ইলিশের প্রজনন মৌসুম আশ্বিন-কার্তিক (অক্টোবর-নভেম্বর)। মূলত ওই সময়ই ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য নদীতে আসে। এরপর অগ্রহায়ণ-পৌষে (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে। কিন্তু বর্তমানে বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার ধুম দেখে মনে হয় এ সময় হয়ত বাংলার খাল-বিলও ইলিশে ভরপুর থাকত!
মাঝে মাঝে ভাবি বৈশাখে ইলিশের খরা ও চড়া বাজারমূল্য দেখেও কি বাঙালির হুঁশ হয় না? সাংস্কৃতিক উৎসবের নামে ব্যবসায়ীরা রমরমা ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। শুধু কি ইলিশ, এখন তো বৈশাখের জন্য নির্দিষ্ট পোশাকও রয়েছে! সংস্কৃতি রক্ষার জন্য তো ওগুলো চাই। হায়, বাংলায় কি আগে শুধু সাদা রংয়ের পোশাক পড়ার হিড়িক ছিল! বরং এখনো গ্রামীণ মেলা উপলক্ষ্যে বাহারি রংয়ের পোশাক পরতে দেখা যায়।
এসব কার্যক্রমের কারণে নববর্ষ আজ শুধু আর বর্ষবরণ নয়, বিশাল এক কর্পোরেট বাণিজ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পহেলা বৈশাখের নামে চলছে উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত ভেজাল সংস্কৃতি আর রমরমা ব্যবসা। ভাত ভিজিয়ে পান্তা বানানো, নদী থেকে ধরে আনা ইলিশকে রাতারাতি মহামূল্য বানিয়ে আর নির্দিষ্ট রং ও ডিজাইনের পোশাক-পরিচ্ছেদ বিক্রির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিশাল অঙ্কের টাকা। দেশের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র জনগণের ওপর চেপে বসছে আরেকটি অযাচিত ব্যয়ের খাত। বিষয়টি নিয়ে নতুন প্রজন্মকে তাই ভাবার পাশাপাশি ইতিহাসের পাতায়ও কিছুটা চোখ বুলিয়ে নিতে হবে।
আসুন সংক্ষেপে বাংলা সন, মাস ও নববর্ষের ইতিহাসে চোখ বুলাই—
বঙ্গাব্দ, বাংলা সন বা বাংলা বর্ষপঞ্জি হল সৌর পঞ্জিকাভিত্তিক বর্ষপঞ্জি। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সৌরদিন গণনা শুরু হয়। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে মোট ৩৬৫ দিন কয়েক ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়। এই সময়টাই এক সৌর বছর। গ্রেগরীয় সনের মতো বঙ্গাব্দেও মোট ১২ মাস। আকাশে সূর্যের অবস্থানের ভিত্তিতে বঙ্গাব্দের মাসের হিসাব হয়ে থাকে।
বঙ্গাব্দ শুরু হয় পহেলা বৈশাখ বা বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে। বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে এ পর্যন্ত পাওয়া মতগুলোর মধ্যে তুলনামূলক নির্ভরযোগ্য মত হলো— ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকদের শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে সব কাজকর্ম পরিচালিত হতো। মূল হিজরী পঞ্জিকা চন্দ্র মাসের ওপর নির্ভরশীল। চন্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর চন্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। এ কারণে চন্দ্র বৎসরে ঋতুগুলো সবসময় একই মাস অনুযায়ী থাকে না। আর চাষাবাদ ও এ জাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এ জন্য মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে প্রচলিত হিজরী চন্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চন্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব দেন। ফতুল্লাহ শিরাজীর সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত সৌর বর্ষপঞ্জির অনুকরণে ৯৯২ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। তবে তিনি ২৯ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহণের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরী সালের মুহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং ১লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
মূলত সুষ্ঠুভাবে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন।
পরবর্তী সময়ে খাজনা আদায়ের এই সময়কাল নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। কারণ বৈশাখ হলো গ্রীষ্মকাল। কৃষিনির্ভর বাঙালিদের জন্য এ সময়ে খাজনা পরিশোধ করা বেশ কষ্টকর। এর চেয়ে বরং হেমন্তকালে খাজনা পরিশোধ করা সহজ। কারণ ওই সময় বাঙালির ঘরে ঘরে ফসল থাকে। ফসল বিক্রির মধ্য দিয়ে সবার হাতে টাকা-পয়সা আসে। ফলে খাজনা পরিশোধে সক্ষম হয় তারা। এ ছাড়া ওই সময় ফসল ঘরে থাকায় পড়ে পিঠা তৈরির ধুম। একই সঙ্গে নদীতে পাওয়া যায় ‘মাছের রাজা’ ইলিশ। তাই এক সময় অগ্রহায়ণ মাসকে কেন্দ্র করে খাজনা আদায়ের জন্য বর্ষ শুরু করা হতো বলে অভিমত দিয়েছেন অনেক ইতিহাসবিদ।
বর্ষবরণ
সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই বর্ষবরণ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন বছরের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পরের দিন ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হতো। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হলো বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।
মাস ও ঋতু পরিচিতি
বঙ্গাব্দের ১২ মাসের নামকরণ করা হযেছে নক্ষত্রমণ্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এই নামগুলো নেওয়া হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকে। বাংলা মাসের নামগুলো হচ্ছে—
বৈশাখ - বিশাখা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
জ্যৈষ্ঠ - জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
আষাঢ় - উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া নক্ষত্রের নাম অনুসারে
শ্রাবণ - শ্রবণা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
ভাদ্র - উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ নক্ষত্রের নাম অনুসারে
আশ্বিন - অশ্বিনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে
কার্তিক - কৃত্তিকা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
অগ্রহায়ণ - মৃগশিরা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
পৌষ - পুষ্যা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
মাঘ - মঘা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
ফাল্গুন - উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী নক্ষত্রের নাম অনুসারে
চৈত্র - চিত্রা নক্ষত্রের নাম অনুসারে
ঋতু
গ্রীষ্ম - বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ
বর্ষা - আষাঢ়, শ্রাবণ
শরৎ - ভাদ্র, আশ্বিন
হেমন্ত - কার্তিক, অগ্রহায়ণ
শীত - পৌষ, মাঘ
বসন্ত - ফাল্গুন, চৈত্র
বাংলা সন সংস্কার
বাংলা একাডেমি বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেয় ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বাধীন কমিটি বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সাংস্কৃতিক জীবনে কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে নির্ণয় করে সেগুলো থেকে উত্তরণের প্রস্তাবনা দেয়। বাংলা সনের ব্যাপ্তি গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির মতোই ৩৬৫ দিনের। যদিও সেখানে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের পরিপূর্ণ সময়কেই যথাযথভাবে নেওয়া হয়েছে। এই প্রদক্ষিণের মোট সময় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড। এই ব্যবধান ঘোচাতে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির প্রতি চার বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করা হয়। ব্যতিক্রম হচ্ছে সে শতাব্দী যাকে ৪০০ দিয়ে ভাগ করা যায় না। জ্যোতির্বিজ্ঞান নির্ভর হলেও বাংলা সনে এই অতিরিক্ত দিনকে আত্মীকরণ করা হয়নি। বাংলা মাস অন্যান্য সনের মাসের মতোই বিভিন্ন পরিসরের হয়ে থাকে। এই সমস্যাগুলোকে দূর করার জন্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র নেতৃত্বাধীন কমিটি বাংলা একাডেমির কাছে কতগুলো প্রস্তাব পেশ করে। এগুলো হলো—
বছরের প্রথম পাঁচ মাস অর্থাৎ বৈশাখ থেকে ভাদ্র হবে ৩১ দিনের। বাকি মাসগুলো অর্থাৎ আশ্বিন থেকে চৈত্র হবে প্রতিটি ৩০ দিনের মাস। প্রতি চতুর্থ বছরের ফাল্গুন মাসে অতিরিক্ত একটি দিন যোগ করে তা হবে ৩১ দিনের। বাংলা একাডেমি সরকারিভাবে এই সংশোধিত বাংলা মাসের হিসাব গ্রহণ করে। ওদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এখনও পুরনো বাংলা সনের প্রচলনই রয়ে গেছে।
বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল বা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। আধুনিক বা প্রাচীন যে কোনো পঞ্জিকাতেই এই বিষয়ে মিল রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমি আধুনিক পঞ্জিকায় এই দিন নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।
বাংলা দিনপঞ্জির সঙ্গে হিজরী ও খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সন ঘড়ির হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে। ইংরেজি দিন শুর হয় মধ্যরাতে। ঐতিহ্যগতভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের (১৯৯৫) ১লা বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমি এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করে।
Comments
Post a Comment