শাহনেওয়াজ খান
আমরা দশ-বারোজন মিলে চারদিক থেকে ঘিরে ধরলাম হরিণের পালটাকে। ৬০-৭০টা হরিণ হবে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে পালটাকে ঘিরে ধরেছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আলো দ্রুত কমে যাচ্ছে। শেষ সময়, সুতরাং সবাই চারদিক দিয়ে এক নিঃশ্বাসে দৌড় দিলাম হরিণের পালকে আটকাতে। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য! আমার দু’পাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে হরিণ। এত জোরে দৌড়াচ্ছে যে পায়ের নিচের খুড়ের অংশগুলো ঠিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। হরিণের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ার ইচ্ছেটা শুরুতেই তো বড় বড় শিং দেখে মারা গিয়েছিল। এখন দৌড় দেখে উল্টো চুপসে গেলাম। মনে মনে প্রার্থনা শুরু করলাম, হে আল্লাহ, শিং বা খুরের আঁচড় যেন গায়ে না লাগে।
বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে, এটা সুন্দরবন বা বিদেশি কোনো সাফারি পার্কের দৃশ্য? না, এটা আমাদের গর্ব নিঝুম দ্বীপের গল্প। খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলোর দ্বীপে যেখানে হরিণই চাঞ্চল্যের উৎস। তবে এই হরিণগুলো কিন্তু শুধু দ্বীপের পরিবেশকেই নয়, মানুষগুলোকেও ব্যস্ত রাখে। দল বেধে এসে নষ্ট করে দেয় ক্ষেতের ফসল।
২০০৯ সালের শুরুর দিকে শীত মৌসুমে গিয়েছিলাম নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ৩য় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্রই ১০-১২ জন মিলে রওয়ানা দিলাম শৈত্যপ্রবাহকে উপেক্ষা করেই। কারণ, এখন দলবল আছে যার, নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার!
একে তো দুর্গম জায়গা তার ওপর ছিল ভয়ঙ্কর দস্যুর ভয়। আমরা যাওয়ার ঠিক কয়েকদিন আগেই দ্বীপটিতে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। পত্রিকায় পড়া এ ঘটনার পাশাপাশি কয়েকজনের কাছে দ্বীপটির ভয়ানক বর্ণনা শুনে আতঙ্কিত হয়ে সহপাঠী বন্ধুরা প্রথমে দ্বীপটিতে যেতে রাজি হয়নি। পরে আমার একগুঁয়েমিতায় কক্সবাজারের পরিকল্পনা বাতিল করে ওখানে যেতে রাজি হয়। দুর্গম ও নিরাপত্তার অভাবে সুন্দর এ দ্বীপটি বেশিরভাগ সময়ই থাকে পর্যটকশূন্য। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন ওই দ্বীপে তিন দিন-দুই রাত অবস্থান করেও অন্য কোনো পর্যটক দেখতে পাইনি। শুধু আসার সময় পথিমধ্যে তিন-চারজনের একটা দল দেখেছিলাম।
যাত্রা শুরু করেছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন, রাতে চট্টগ্রাম শহর থেকে নোয়াখালীগামী বাস। বাস থেকে গভীর রাতে নেমে শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে রাস্তার ধারে মাছ বাজারের খালি চকিতে শুয়ে-বসে দুই ঘণ্টা কাটালাম। উপর থেকে পড়ছে ঘন কুয়াশা, আর খালি আকাশের নিচে শুয়ে ভিজে কাঁপছি আমরা। ভোর হতেই হেঁটে হাতিয়া যাওয়ার লঞ্চঘাটে। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে লঞ্চ ভ্রমণ শেষে অবশেষে হাতিয়ায়। এরপর সেখান থেকে স্থানীয় টমটমে উঠে আরও আড়াই-তিন ঘণ্টা পর হাতিয়ার আরেক প্রান্তে পৌঁছলাম। তারপর রিকশা ভ্রমণ। সেখানেও প্রায় একই সময়। এরপর নৌকা। বিমান ছাড়া প্রায় সকল ধরনের যানবাহন ব্যবহার করে ২২ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে সন্ধ্যায় পৌঁছলাম আকাঙ্ক্ষিত নিঝুম দ্বীপে! তারপরও কী ভ্রমণ শেষ হলো। আরও ৪০ মিনিট হেঁটে পৌঁছলাম নিঝুপ দ্বীপের বাজারে।
ভ্রমণের ভোগান্তি থেকে সবাই আপাতত রক্ষা পেলাম। আমার ভোগান্তি ছিল অন্যদের চেয়ে একটু বেশি। রাস্তায় ভোগান্তির পুরো সময় জুড়ে এখানে নিয়ে আসার জন্য কটাক্ষ সইতে হয়েছিল আমাকে। তবে প্রথম দর্শনেই দ্বীপের সৌন্দর্য দেখে সবাই মুগ্ধ হওয়ায় রক্ষা! বিস্তীর্ণ জলরাশির মাঝে ভাসমান সবুজ ম্যানগ্রোভ বন দেখলে কার না চোখ না জুড়ায়। এমন মুগ্ধকর সৌন্দর্যে বিমোহিত ব্যক্তির মনে কি আর ক্ষোভ অবশিষ্ট থাকে!
উঠলাম ভাড়ায় থাকার হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত স্থানীয় সাইক্লোন সেন্টারে। খাওয়ার জন্য বলে রাখলাম বাজারের হোটেলে। বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করা দরকার। এখানে হোটেলরূপী সাইক্লোন সেন্টারে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা নেই। তাই বাজারের হোটেলে খেতে হয়। সেখানে স্থানীয় মাছ, ডিম ছাড়া বেশি কিছু পাওয়া যায় না। তাও আবার সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরেই শেষ। রান্নাও সেখানকার লোকদের জন্যই করা। এক্ষেত্রে ওদের আগে থেকে নির্দিষ্ট তরকারির কথা বলে রাখলে তারা ব্যবস্থা করে রাখবে। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হবে না, কিন্তু অপেক্ষাকৃত ভালো রান্না পাওয়া যাবে। তার চেয়েও বড় কথা একটু দেরি হলেও ওরা অপেক্ষা করবে।
তর সইছিল না। তাই বিশাল ভ্রমণে ক্লান্ত শরীর নিয়েই কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে বিকালেই ছুটলাম জঙ্গলের পানে। ঘুরে-ফিরে এসে রাতে অল্প কয়েক ঘন্টার বিশ্রাম। পরদিন ভোরেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম নিঝুম দ্বীপের পূর্ণ সৌন্দর্য অন্বেষণে। আপাদমস্তক কেওড়া বনে ঘেরা নিঝুম দ্বীপের চারদিকেই সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। কোন দিকে যাই? নানা চিন্তা-ভাবনা শেষে ঢুকলাম বনে। কিছুদূর হাঁটার পর দেখলাম চারদিকে শুধু হরিণের পায়ের ছাপ। তার মানে, এদিকে হরিণের চলাচল বেশ নিয়মিত। হঠাৎ দূর থেকে হরিণের ছোট একটা দল দেখে শুরু হল পিছু নেওয়া। একে তো কাদামাটি তার ওপর কাঁটা কাঁটা ঘাস, কেওড়া গাছের শ্বাসমূল তো আছেই। এর মাঝ দিয়েও কীভাবে আমরা হরিণের পেছনে দৌড়েছিলাম তা মনে পড়লে এখনও বেশ অবাক হই।
হরিণ দৌড়ানোর পর দুপুরে গেলাম মোহনায়। সমুদ্র ও নদীর মিলনস্থলের এক অপূর্ব দৃশ্য। এই মিলনস্থলেই গড়ে উঠেছে সুন্দর এক সৈকত। সৈকত থেকে হোটেলের কক্ষে ফিরে যাওয়ার আয়োজন। কারণ আমাদের পরিকল্পিত ভ্রমনের মেয়াদ শেষ। কিন্তু নিজুম দ্বীপের সৌন্দর্যে বিমোহিত মন এত দ্রুত ফিরতে চাইছিল না। তাই কয়েকজন আরও একদিন থাকতে চাইছিলাম। আর আমাদের বাজেটের চেয়েও তো খরচ অনেক কম হচ্ছে। অবশেষে ভোটাভুটি। কিন্তু এখানেও বিপদ। উভয়পক্ষে ভোট সমান-সমান। তখনও ভোট দেয়নি ‘সুপার স্লো’ রাজু। নানা তোষামোদি আর সময়ক্ষেপণের পর অবশেষে রাজু থাকার পক্ষেই ভোট দিল। রাজুর ওই ‘দুধভাত’ ভোটই তখন আমাদের কাছে মহামূল্যবান!
বিকালেই আবার ‘মিশন হরিণ’। এবার যেভাবেই হোক হরিণ ধরতেই হবে। সারাদিন ঘুরে অবশেষে বিকালের শেষ প্রান্তে দুবাই খালের পাশে ঘিরে ধরলাম একটি দলকে। এরপরের কাহিনী তো পাঠকের আগে থেকেই জানা।
হরিণ মিশনে খালের উপর অবস্থিত মাত্র এক বাঁশের দীর্ঘ সাঁকো পার হওয়ার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আমার মতো শহুরে ছেলের আজীবন মনে থাকবে। সাঁকোটির অনেক স্থানে হাতে ধরার বাঁশটি অনকে দূরে। সেখানে সার্কাসকর্মীর মতো ঢিপ ঢিপ বুকে ধীরে ধীরে পার হতে হয়েছে। সন্ধ্যার পর হরিণ মিশন শেষ হওয়ায় বাজারে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। রাস্তায় সাপ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর ভয়ে আওয়াজ করে ও গান গেয়ে হাঁটার ঘটনাও মনে রাখার মতো!
পরদিন ভোরে উঠে নিঝুম দ্বীপকে বিদায় জানাতে প্রস্তুত হলাম। ফজরের নামাজ পড়ে কুয়াশাঘেরা শীতের সকালে ফিরতি পথে রওয়ানা দিলাম। দ্বীপের শেষপ্রান্তে এসে শান্ত দ্বীপটির দিকে চোখ বুলাতেই বুঝলাম তার ‘নিঝুম’ নামের স্বার্থকতা। চুপচাপ, স্নিগ্ধ ‘দ্বীপ’ নামক চরটি সহজে ছাড়তে চাইছিল না। তারপরও আমাদের দ্রুত যেতে হবে, নয়ত হারাব হাতিয়া থেকে চেয়ারম্যান ঘাটগামী লঞ্চ।
এর মাঝে অবশ্য নৌকার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে গিয়ে ভেঙ্গে ফেলেছিলাম নিকটস্থ মুদি দোকানের একটি চৌকি! হ্যাঁ, ছোট্ট চৌকিটাতে সবাই মিলে বসতে গেলে ওই অবস্থা হয়। তারপর আর কি, বাহাদুরির আক্কেলসেলামি দিয়ে সে যাত্রায় রেহাই পেলাম। চকি ভাঙ্গার ক্ষেত্রেও রাজুর ছিল মহাগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
ফেরার পথে হাতিয়ায় ‘অর্ধেক’ দুর্ঘটনার শিকার হই। রাস্তায় একটি মালবাহী ট্রাক্টর আমাদের ডিজেলচালিত অটোরিক্সাকে (বেবিট্যাক্সি) ধাক্কা দেয়। ট্রাক্সিটি উল্টে যেতে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে যায়। একপাশ উপরে উঠে যাওয়া ট্যাক্সির ধাক্কা খাওয়া প্রান্তে ছিল এনাম। ও সামান্য আঘাতও পায়। আর নিচু হয়ে পড়া প্রান্তে ছিলাম আমি। যাক, আল্লাহর রহমতে নিশ্চিত দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাই আমরা।
পাঠকদের জানিয়ে রাখি বনের মাঝে হরিণের পানি পানের জন্য খাল কেটে দিয়েছে বন বিভাগ। খালে সকাল-বিকাল সময় করে দল বেধে পানি পান করতে আসে হরিণ। হরিণ দেখার ওটাই উপযুক্ত সময়।
এবার আমাদের গল্প ছেড়ে দ্বীপের গল্প বলি। নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অর্ন্তগত নিঝুম দ্বীপ মূলত একটি ‘চর’। ১৯৪০ এর দশকে জেগে ওঠা দ্বীপটি নানা সময়ে ‘ইছামতির দ্বীপ’, ‘বাইল্যার ডেইল’, ‘চর ওসমান’ নাম ধারণ করলেও সবশেষে ‘নিঝুম দ্বীপ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৪শ’ একরের দ্বীপটিতে সাহসী বাথানিয়া ওসমান তার মহিষের বাথান নিয়ে আসেন। তার নামেই এক সময় ‘চর ওসমান’ নামে পরিচিতি পাওয়া নিঝুম দ্বীপে মৌজার সরকারি নামও ‘চর ওসমান’।
দ্বীপটি কিন্তু প্রথম দিকে মানুষের বসবাসের উপযোগী ছিল না। নদী ও সমুদ্রের মোহনায় জেগে ওঠা চরটিতে ১৯৭০ এর দশকে কেওড়া গাছ লাগানো শুরু করে বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগ। তৈরি করে বিশাল কেওড়া বন। এরপর ছাড়া হয় হরিণ। মাত্র চারটা হরিণ দিয়ে যাত্রা শুরু করা দ্বীপটিতে এক সময় হরিণের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২ হাজারে। ২০০৭ সালে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় সিডরে মারা যায় এর অর্ধেক।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও মানুষের হরিণ শিকারের কারণে দ্বীপটিতে হরিণের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। স্থানীয়রা নিজেরা সরাসরি না মারলেও হরিণ শিকারে এক ধরনের কুকুর পোষে। কুকুরগুলো দেখতে অনেকটা হায়েনার মতো। এ ছাড়া হরিণের হাত থেকে ফসল বাঁচাতে ক্ষেতগুলোর চারপাশে দেওয়া হয় জালের বেড়া। সেখানে আটকেও কিছু হরিণ মারা যায়।
কোস্টগার্ড ও বন বিভাগের কর্মকর্তাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও বনের গাছ কাটা অব্যাহত রয়েছে। মানুষের এ নির্মমতাই দ্বীপটিকে অনেকটা হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
যাতায়াত : নোয়াখালীর সোনাপুর বাসস্ট্যান্ড হয়ে চেয়ারম্যান ঘাট। সেখান থেকে লঞ্চ বা স্টিমারে হাতিয়ার নলচিরা ঘাট। সেখান থেকে স্থানীয় টমটম বা সিএনজি অটোরিক্সায় জাহাজমারা ঘাট বা হাতিয়া উপজেলা সদর পেরিয়ে নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার স্ট্যান্ড। জাহাজমারা ঘাট থেকে নৌকাযোগে নিঝুম দ্বীপে যাওয়া যায়। তবে উপজেলা সদরে গেলে রিক্সাযোগে নিঝুম দ্বীপের ঘাটে গিয়ে অল্পপথ নৌকায় পার হলেই নিঝুম দ্বীপ।
সতর্কতা : নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবসময় মাথায় রাখতে হবে তা হল যানবাহনের সময়সূচি। লঞ্চগুলো সকালের দিকে যাতায়াত করে। একবার কোনোটা হারালেই সারাদিন ওই এলাকায় আটকে থাকতে হবে। সুতরাং, যাওয়ার আগে বা যাওয়ার পর সবার আগে সময়সূচি ভালভাবে জেনে নেবেন।
(ছবি : সংগৃহীত। নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুৎ নেই। তাই সেখানে গিয়ে কেউ মোবাইল বা ক্যামেরায় চার্জ দিতে পারেনি। এ কারণে আমাদের কোনো ছবি তোলা হয়নি।
ভ্রমণে যারা ছিলাম— বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি, ইমরোজ, নাহিদ, এনাম, রাহাত, রাজু, ফরহাদ, আবির। এ ছাড়া নোয়াখালী থেকে শওকত ভাই ও চট্টগ্রাম থেকে মহিম। নিঝুম দ্বীপে সার্বিক সহায়তায় ছিলেন আলতাফের চাচাত ভাই জহির। নিরাপদে দ্বীপটি ঘুরে দেখা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন তিনি।)
আমরা দশ-বারোজন মিলে চারদিক থেকে ঘিরে ধরলাম হরিণের পালটাকে। ৬০-৭০টা হরিণ হবে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে পালটাকে ঘিরে ধরেছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আলো দ্রুত কমে যাচ্ছে। শেষ সময়, সুতরাং সবাই চারদিক দিয়ে এক নিঃশ্বাসে দৌড় দিলাম হরিণের পালকে আটকাতে। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য! আমার দু’পাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে হরিণ। এত জোরে দৌড়াচ্ছে যে পায়ের নিচের খুড়ের অংশগুলো ঠিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। হরিণের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ার ইচ্ছেটা শুরুতেই তো বড় বড় শিং দেখে মারা গিয়েছিল। এখন দৌড় দেখে উল্টো চুপসে গেলাম। মনে মনে প্রার্থনা শুরু করলাম, হে আল্লাহ, শিং বা খুরের আঁচড় যেন গায়ে না লাগে।
বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে, এটা সুন্দরবন বা বিদেশি কোনো সাফারি পার্কের দৃশ্য? না, এটা আমাদের গর্ব নিঝুম দ্বীপের গল্প। খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলোর দ্বীপে যেখানে হরিণই চাঞ্চল্যের উৎস। তবে এই হরিণগুলো কিন্তু শুধু দ্বীপের পরিবেশকেই নয়, মানুষগুলোকেও ব্যস্ত রাখে। দল বেধে এসে নষ্ট করে দেয় ক্ষেতের ফসল।
২০০৯ সালের শুরুর দিকে শীত মৌসুমে গিয়েছিলাম নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ৩য় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্রই ১০-১২ জন মিলে রওয়ানা দিলাম শৈত্যপ্রবাহকে উপেক্ষা করেই। কারণ, এখন দলবল আছে যার, নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার!
একে তো দুর্গম জায়গা তার ওপর ছিল ভয়ঙ্কর দস্যুর ভয়। আমরা যাওয়ার ঠিক কয়েকদিন আগেই দ্বীপটিতে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। পত্রিকায় পড়া এ ঘটনার পাশাপাশি কয়েকজনের কাছে দ্বীপটির ভয়ানক বর্ণনা শুনে আতঙ্কিত হয়ে সহপাঠী বন্ধুরা প্রথমে দ্বীপটিতে যেতে রাজি হয়নি। পরে আমার একগুঁয়েমিতায় কক্সবাজারের পরিকল্পনা বাতিল করে ওখানে যেতে রাজি হয়। দুর্গম ও নিরাপত্তার অভাবে সুন্দর এ দ্বীপটি বেশিরভাগ সময়ই থাকে পর্যটকশূন্য। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন ওই দ্বীপে তিন দিন-দুই রাত অবস্থান করেও অন্য কোনো পর্যটক দেখতে পাইনি। শুধু আসার সময় পথিমধ্যে তিন-চারজনের একটা দল দেখেছিলাম।
যাত্রা শুরু করেছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন, রাতে চট্টগ্রাম শহর থেকে নোয়াখালীগামী বাস। বাস থেকে গভীর রাতে নেমে শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে রাস্তার ধারে মাছ বাজারের খালি চকিতে শুয়ে-বসে দুই ঘণ্টা কাটালাম। উপর থেকে পড়ছে ঘন কুয়াশা, আর খালি আকাশের নিচে শুয়ে ভিজে কাঁপছি আমরা। ভোর হতেই হেঁটে হাতিয়া যাওয়ার লঞ্চঘাটে। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে লঞ্চ ভ্রমণ শেষে অবশেষে হাতিয়ায়। এরপর সেখান থেকে স্থানীয় টমটমে উঠে আরও আড়াই-তিন ঘণ্টা পর হাতিয়ার আরেক প্রান্তে পৌঁছলাম। তারপর রিকশা ভ্রমণ। সেখানেও প্রায় একই সময়। এরপর নৌকা। বিমান ছাড়া প্রায় সকল ধরনের যানবাহন ব্যবহার করে ২২ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে সন্ধ্যায় পৌঁছলাম আকাঙ্ক্ষিত নিঝুম দ্বীপে! তারপরও কী ভ্রমণ শেষ হলো। আরও ৪০ মিনিট হেঁটে পৌঁছলাম নিঝুপ দ্বীপের বাজারে।
ভ্রমণের ভোগান্তি থেকে সবাই আপাতত রক্ষা পেলাম। আমার ভোগান্তি ছিল অন্যদের চেয়ে একটু বেশি। রাস্তায় ভোগান্তির পুরো সময় জুড়ে এখানে নিয়ে আসার জন্য কটাক্ষ সইতে হয়েছিল আমাকে। তবে প্রথম দর্শনেই দ্বীপের সৌন্দর্য দেখে সবাই মুগ্ধ হওয়ায় রক্ষা! বিস্তীর্ণ জলরাশির মাঝে ভাসমান সবুজ ম্যানগ্রোভ বন দেখলে কার না চোখ না জুড়ায়। এমন মুগ্ধকর সৌন্দর্যে বিমোহিত ব্যক্তির মনে কি আর ক্ষোভ অবশিষ্ট থাকে!
উঠলাম ভাড়ায় থাকার হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত স্থানীয় সাইক্লোন সেন্টারে। খাওয়ার জন্য বলে রাখলাম বাজারের হোটেলে। বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করা দরকার। এখানে হোটেলরূপী সাইক্লোন সেন্টারে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা নেই। তাই বাজারের হোটেলে খেতে হয়। সেখানে স্থানীয় মাছ, ডিম ছাড়া বেশি কিছু পাওয়া যায় না। তাও আবার সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পরেই শেষ। রান্নাও সেখানকার লোকদের জন্যই করা। এক্ষেত্রে ওদের আগে থেকে নির্দিষ্ট তরকারির কথা বলে রাখলে তারা ব্যবস্থা করে রাখবে। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হবে না, কিন্তু অপেক্ষাকৃত ভালো রান্না পাওয়া যাবে। তার চেয়েও বড় কথা একটু দেরি হলেও ওরা অপেক্ষা করবে।
তর সইছিল না। তাই বিশাল ভ্রমণে ক্লান্ত শরীর নিয়েই কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে বিকালেই ছুটলাম জঙ্গলের পানে। ঘুরে-ফিরে এসে রাতে অল্প কয়েক ঘন্টার বিশ্রাম। পরদিন ভোরেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম নিঝুম দ্বীপের পূর্ণ সৌন্দর্য অন্বেষণে। আপাদমস্তক কেওড়া বনে ঘেরা নিঝুম দ্বীপের চারদিকেই সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। কোন দিকে যাই? নানা চিন্তা-ভাবনা শেষে ঢুকলাম বনে। কিছুদূর হাঁটার পর দেখলাম চারদিকে শুধু হরিণের পায়ের ছাপ। তার মানে, এদিকে হরিণের চলাচল বেশ নিয়মিত। হঠাৎ দূর থেকে হরিণের ছোট একটা দল দেখে শুরু হল পিছু নেওয়া। একে তো কাদামাটি তার ওপর কাঁটা কাঁটা ঘাস, কেওড়া গাছের শ্বাসমূল তো আছেই। এর মাঝ দিয়েও কীভাবে আমরা হরিণের পেছনে দৌড়েছিলাম তা মনে পড়লে এখনও বেশ অবাক হই।
হরিণ দৌড়ানোর পর দুপুরে গেলাম মোহনায়। সমুদ্র ও নদীর মিলনস্থলের এক অপূর্ব দৃশ্য। এই মিলনস্থলেই গড়ে উঠেছে সুন্দর এক সৈকত। সৈকত থেকে হোটেলের কক্ষে ফিরে যাওয়ার আয়োজন। কারণ আমাদের পরিকল্পিত ভ্রমনের মেয়াদ শেষ। কিন্তু নিজুম দ্বীপের সৌন্দর্যে বিমোহিত মন এত দ্রুত ফিরতে চাইছিল না। তাই কয়েকজন আরও একদিন থাকতে চাইছিলাম। আর আমাদের বাজেটের চেয়েও তো খরচ অনেক কম হচ্ছে। অবশেষে ভোটাভুটি। কিন্তু এখানেও বিপদ। উভয়পক্ষে ভোট সমান-সমান। তখনও ভোট দেয়নি ‘সুপার স্লো’ রাজু। নানা তোষামোদি আর সময়ক্ষেপণের পর অবশেষে রাজু থাকার পক্ষেই ভোট দিল। রাজুর ওই ‘দুধভাত’ ভোটই তখন আমাদের কাছে মহামূল্যবান!
বিকালেই আবার ‘মিশন হরিণ’। এবার যেভাবেই হোক হরিণ ধরতেই হবে। সারাদিন ঘুরে অবশেষে বিকালের শেষ প্রান্তে দুবাই খালের পাশে ঘিরে ধরলাম একটি দলকে। এরপরের কাহিনী তো পাঠকের আগে থেকেই জানা।
হরিণ মিশনে খালের উপর অবস্থিত মাত্র এক বাঁশের দীর্ঘ সাঁকো পার হওয়ার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা আমার মতো শহুরে ছেলের আজীবন মনে থাকবে। সাঁকোটির অনেক স্থানে হাতে ধরার বাঁশটি অনকে দূরে। সেখানে সার্কাসকর্মীর মতো ঢিপ ঢিপ বুকে ধীরে ধীরে পার হতে হয়েছে। সন্ধ্যার পর হরিণ মিশন শেষ হওয়ায় বাজারে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায়। রাস্তায় সাপ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর ভয়ে আওয়াজ করে ও গান গেয়ে হাঁটার ঘটনাও মনে রাখার মতো!
পরদিন ভোরে উঠে নিঝুম দ্বীপকে বিদায় জানাতে প্রস্তুত হলাম। ফজরের নামাজ পড়ে কুয়াশাঘেরা শীতের সকালে ফিরতি পথে রওয়ানা দিলাম। দ্বীপের শেষপ্রান্তে এসে শান্ত দ্বীপটির দিকে চোখ বুলাতেই বুঝলাম তার ‘নিঝুম’ নামের স্বার্থকতা। চুপচাপ, স্নিগ্ধ ‘দ্বীপ’ নামক চরটি সহজে ছাড়তে চাইছিল না। তারপরও আমাদের দ্রুত যেতে হবে, নয়ত হারাব হাতিয়া থেকে চেয়ারম্যান ঘাটগামী লঞ্চ।
এর মাঝে অবশ্য নৌকার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে গিয়ে ভেঙ্গে ফেলেছিলাম নিকটস্থ মুদি দোকানের একটি চৌকি! হ্যাঁ, ছোট্ট চৌকিটাতে সবাই মিলে বসতে গেলে ওই অবস্থা হয়। তারপর আর কি, বাহাদুরির আক্কেলসেলামি দিয়ে সে যাত্রায় রেহাই পেলাম। চকি ভাঙ্গার ক্ষেত্রেও রাজুর ছিল মহাগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
ফেরার পথে হাতিয়ায় ‘অর্ধেক’ দুর্ঘটনার শিকার হই। রাস্তায় একটি মালবাহী ট্রাক্টর আমাদের ডিজেলচালিত অটোরিক্সাকে (বেবিট্যাক্সি) ধাক্কা দেয়। ট্রাক্সিটি উল্টে যেতে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে যায়। একপাশ উপরে উঠে যাওয়া ট্যাক্সির ধাক্কা খাওয়া প্রান্তে ছিল এনাম। ও সামান্য আঘাতও পায়। আর নিচু হয়ে পড়া প্রান্তে ছিলাম আমি। যাক, আল্লাহর রহমতে নিশ্চিত দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাই আমরা।
পাঠকদের জানিয়ে রাখি বনের মাঝে হরিণের পানি পানের জন্য খাল কেটে দিয়েছে বন বিভাগ। খালে সকাল-বিকাল সময় করে দল বেধে পানি পান করতে আসে হরিণ। হরিণ দেখার ওটাই উপযুক্ত সময়।
এবার আমাদের গল্প ছেড়ে দ্বীপের গল্প বলি। নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অর্ন্তগত নিঝুম দ্বীপ মূলত একটি ‘চর’। ১৯৪০ এর দশকে জেগে ওঠা দ্বীপটি নানা সময়ে ‘ইছামতির দ্বীপ’, ‘বাইল্যার ডেইল’, ‘চর ওসমান’ নাম ধারণ করলেও সবশেষে ‘নিঝুম দ্বীপ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ১৪শ’ একরের দ্বীপটিতে সাহসী বাথানিয়া ওসমান তার মহিষের বাথান নিয়ে আসেন। তার নামেই এক সময় ‘চর ওসমান’ নামে পরিচিতি পাওয়া নিঝুম দ্বীপে মৌজার সরকারি নামও ‘চর ওসমান’।
দ্বীপটি কিন্তু প্রথম দিকে মানুষের বসবাসের উপযোগী ছিল না। নদী ও সমুদ্রের মোহনায় জেগে ওঠা চরটিতে ১৯৭০ এর দশকে কেওড়া গাছ লাগানো শুরু করে বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগ। তৈরি করে বিশাল কেওড়া বন। এরপর ছাড়া হয় হরিণ। মাত্র চারটা হরিণ দিয়ে যাত্রা শুরু করা দ্বীপটিতে এক সময় হরিণের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২ হাজারে। ২০০৭ সালে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় সিডরে মারা যায় এর অর্ধেক।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও মানুষের হরিণ শিকারের কারণে দ্বীপটিতে হরিণের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। স্থানীয়রা নিজেরা সরাসরি না মারলেও হরিণ শিকারে এক ধরনের কুকুর পোষে। কুকুরগুলো দেখতে অনেকটা হায়েনার মতো। এ ছাড়া হরিণের হাত থেকে ফসল বাঁচাতে ক্ষেতগুলোর চারপাশে দেওয়া হয় জালের বেড়া। সেখানে আটকেও কিছু হরিণ মারা যায়।
কোস্টগার্ড ও বন বিভাগের কর্মকর্তাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও বনের গাছ কাটা অব্যাহত রয়েছে। মানুষের এ নির্মমতাই দ্বীপটিকে অনেকটা হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
যাতায়াত : নোয়াখালীর সোনাপুর বাসস্ট্যান্ড হয়ে চেয়ারম্যান ঘাট। সেখান থেকে লঞ্চ বা স্টিমারে হাতিয়ার নলচিরা ঘাট। সেখান থেকে স্থানীয় টমটম বা সিএনজি অটোরিক্সায় জাহাজমারা ঘাট বা হাতিয়া উপজেলা সদর পেরিয়ে নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার স্ট্যান্ড। জাহাজমারা ঘাট থেকে নৌকাযোগে নিঝুম দ্বীপে যাওয়া যায়। তবে উপজেলা সদরে গেলে রিক্সাযোগে নিঝুম দ্বীপের ঘাটে গিয়ে অল্পপথ নৌকায় পার হলেই নিঝুম দ্বীপ।
সতর্কতা : নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবসময় মাথায় রাখতে হবে তা হল যানবাহনের সময়সূচি। লঞ্চগুলো সকালের দিকে যাতায়াত করে। একবার কোনোটা হারালেই সারাদিন ওই এলাকায় আটকে থাকতে হবে। সুতরাং, যাওয়ার আগে বা যাওয়ার পর সবার আগে সময়সূচি ভালভাবে জেনে নেবেন।
(ছবি : সংগৃহীত। নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুৎ নেই। তাই সেখানে গিয়ে কেউ মোবাইল বা ক্যামেরায় চার্জ দিতে পারেনি। এ কারণে আমাদের কোনো ছবি তোলা হয়নি।
ভ্রমণে যারা ছিলাম— বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি, ইমরোজ, নাহিদ, এনাম, রাহাত, রাজু, ফরহাদ, আবির। এ ছাড়া নোয়াখালী থেকে শওকত ভাই ও চট্টগ্রাম থেকে মহিম। নিঝুম দ্বীপে সার্বিক সহায়তায় ছিলেন আলতাফের চাচাত ভাই জহির। নিরাপদে দ্বীপটি ঘুরে দেখা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন তিনি।)
Comments
Post a Comment