Skip to main content

আমি আমার ধর্মকে অস্বীকার করি না




নিউজ এক্সপ্রেস : মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে ১৯৭৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা একটি ক্রোড়পত্র বের করেছিল। সেখানে মোহাম্মদ আলীর নিজের একটি লেখা ছাপা হয়েছিল, শিরোনাম, ‘আমি আমার ধর্মকে অস্বীকার করি না।’ এই লেখায় তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের কথা অর্থাৎ ১৯৬৪ সালে প্রথম বিশ্ব শিরোপা অর্জনের পূর্ব মুহূর্তের টানাপোড়েনের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথম আলোর সৌজন্যে সেটি তুলে ধরা হল-

আমি চিকাগোতে একটি বাস কিনেছিলাম; সেই বাসে করে সোজাসুজি লাসভিলে যাই। সেখানে ছিলেন আমার পরিচিত একজন নকশাশিল্পী, আমার পিতা। তিনি একপাশে লিখেছিলেন কমলা-সবুজ-লাল-হলুদ এবং নীল, অবশ্য বেশির ভাগ লাল রঙে: ‘আকর্ষণীয় যোদ্ধা: কেসিয়াস ক্লে’। আর একপাশে লেখা ছিল: ‘সোনি লিস্টন সেরা যোদ্ধা, কিন্তু তিনি ধরাশায়ী হবেন অষ্টম রাউন্ডে।’ আমি একে বলেছি বিশাল লাল।

দুপাশে ঘুরেছি। ঘুরেছি সারা দেশ। আবৃত্তি করেছি কবিতার মতো, লিস্টনের পতন হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছি। খেতাবি লড়াইয়ের জন্য এমন জোরদার প্রচার অভিযান চালিয়েছি, তেমন জোরদার প্রচার অভিযান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও খুব কম প্রার্থীই করেন। প্রচার অভিযানে আমার প্রিয় স্লোগান ছিল ‘ক্লের মুষ্টি’।

গত ছয় মাসে প্রতি পদক্ষেপে আমি লিস্টনকে পরাভূত করেছি। চ্যালেঞ্জ করেছি, ভবিষ্যদ্বাণী করেছি তার (সনি লিস্টন) পতনের, অভিহিত করেছি তাকে বিকট কদাকার ভালুক বলে, যার ফলে তার কিংবা সংবাদপত্রের পক্ষে আমাকে উপেক্ষা করা অসাধ্য হয়ে ওঠে। এক কথায়, আমার সমস্ত প্রচার অভিযানে আমাকে খেতাবি লড়াই দানের জন্য প্রমোটরদের ওপর চাপ সৃষ্টির সুযোগ পেয়েছিলাম।

কেবল তা-ই নয়, এই অভিযানে নতুন কিছু পেয়েছিলাম, যার মূল্য আমার কাছে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপের মর্যাদার থেকেও বেশি ছিল। এখন আমার যে অনুভূতি হয়, তা আমার জীবনের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন। যখন ড্রেসিং রুমে অ্যাঞ্জেলো ভয়ংকর দৃষ্টি মেলে বলেছিলেন, ‘সেখানে কে আছে তুমি কি জান?’ তিনি দরজা অর্ধেক খুলে রিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যালকম এক্সের (কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম নেতা) দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। দৃষ্টি ছিল তাঁর মুষ্টিযুদ্ধের পুরোনো পোস্টারের দিকে। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি কি বুঝতে পারছ যদি সংবাদপত্র এ ঘটনা তুলে ধরে তবে কী হবে? তারা তোমাকে ধিক্কৃত করবে, তোমার নিন্দা করবে, এ লড়াইকে নস্যাৎ করে দেবে।’ ভয়ার্ত দৃষ্টি মেলে বলেছিলেন, ‘তুমি দয়া করে তাকে এখান থেকে সরিয়ে দাও। সংবাদপত্র যদি জানতে পারে তুমি ম্যালকম এক্সের মতো মুসলমানদের সঙ্গে জড়িত আছ, তবে তোমার ভবিষ্যৎ নস্যাৎ হয়ে যাবে।’ ‘তুমি কি বুঝতে পারছ?’ তার কণ্ঠে প্রশ্ন।

এখন পর্যন্ত আমি একজন শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে যতখানি ঘনিষ্ঠ, ঠিক ততখানি ঘনিষ্ঠ আছি অ্যাঞ্জেলোর সঙ্গেও। তিনি কেবল জানতেন না ম্যালকম একমাত্র এক্স নয়, আমিও কেসিয়াস এক্স। আমি নিজেও মহামান্য এলিজা মোহাম্মদের (কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম নেতা) অনুসারী। অ্যাঞ্জেলো মনে করেছিলেন তিনি কোনো রেখাপাত করতে পারছেন না। আর তাই আকস্মিকভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে স্থান পরিবর্তন করলেন। আমি পরে জেনেছি, তিনি তার ভাই ক্রিসকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং ক্রিস সঙ্গে সঙ্গে প্রমোটর বিল ম্যাকডোনাল্ডকে খবর দিয়েছিলেন। এই ম্যাকডোনাল্ডই হাজার হাজার ডলার ব্যয় করে এই সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন, যে সমাবেশ মুষ্টিযুদ্ধের ইতিহাসের বৃহত্তম হেভিওয়েট খেতাবি লড়াই বলে পরিগণিত হয়েছে।

ক্রিস আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন: কেসিয়াস, তোমার কি এক মিনিট সময় হবে? ম্যাকডোনাল্ড তোমাকে তার অফিসে যেতে বলেছেন।
কী ব্যাপার গুন্ডাজি? আমি তাকে প্রশ্ন করি। যদিও ক্রিস এবং অ্যাঞ্জেলো আমার বন্ধু ও প্রশিক্ষক, তবু আমি রসিকতা করে ক্রিসকে গুন্ডাজি বলে সম্বোধন করি। এর মূল কারণ এই যে ক্রিসের মুষ্টিযুদ্ধের সোনালি দিনগুলোতে ছিল দুর্বৃত্তদের আধিপত্য।
ক্রিস খুব আস্তে আস্তে বললেন, এক মিনিটের বেশি লাগবে না। ভাবখানা এই যে তিনি কেবল আমাকে জানাতেই এসেছিলেন।
আমি কাপড় পরে নিই এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে ক্রিস ও আমার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ওয়াশিংটন স্ট্রিট ধরে কনভেনশন হলে ম্যাকডোনাল্ডের অফিসে হাজির হলাম। তখন ছিল সূর্যস্নাত দিন। রাস্তায় অনেকেই আমাকে থামিয়ে অটোগ্রাফ নিয়েছেন, লিস্টন সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছেন অথবা শুভকামনা করে বলেছেন, ‘জয় হোক তোমার।’ তখন ক্রিস ঘড়ি দেখছিলেন আর বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘ম্যাকডোনাল্ড অপেক্ষা করছেন।’

অফিসে পৌঁছে আমার ভাইকে ঠেলে দিই আগে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ক্রিস তাকে থামিয়ে বললেন, ‘ম্যাকডোনাল্ড তোমাকে চায়, তোমার ভাইকে নয়।’ আমি ইতস্তত করি, ভাবতে থাকি, এমন কী ব্যাপার যা আমার ছোট ভাই শুনতে পারবে না? কিন্তু রুডি একপাশে সরে গিয়ে বিনীতভাবে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি বাইরেই অপেক্ষা করি।’ ক্রিস ও আমি অগত্যা প্রমোটরের অফিসে প্রবেশ করলাম।

ম্যাকডোনাল্ড একজন দীর্ঘদেহী মানুষ। তার চুল বাদামি রঙের আর মুখ বড় ও লালচে আকৃতির। তিনি ক্রিসকে বললেন দরজা বন্ধ করে দিতে। তারপর আমার দিকে দৃষ্টি মেলে ক্রিসের দেওয়া একটা মোটা সিগার ধরাতে ধরাতে আমাকে বললেন, ‘কেসিয়াস, সপ্তাহ খানেক আগে কি তুমি সত্যিই নিউইয়র্কে গিয়ে নিউইয়র্ক ইসলাম জাতির মসজিদে উঠেছিলে? তোমাকে কি প্রকাশ্যে কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানদের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল? তুমি কি সারা দিন সেখানে কাটিয়েছিলে এবং সাংবাদিকদের, যারা তাদের সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তখন তুমি কি তাদের পক্ষে (কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম) কথা বলেছিলে?’
‘সবকিছুই সত্যি।’ আমি জবাব দিই।
ম্যাকডোনাল্ড তার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। তখন তাকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। কণ্ঠস্বর দৃঢ়। তখন থেকে তিনি বাদীপক্ষের উকিলের মতো আসামির দণ্ডাদেশকে যেকোনো পন্থায় ন্যায়সংগত প্রমাণ করার জন্য সাক্ষ্য-প্রমাণ তুলে ধরতে লাগলেন। বাদীপক্ষের উকিলের মতোই তিনি বললেন, ‘ম্যালকম এক্স কি তোমার আমন্ত্রণেই এখানকার জিমনেসিয়ামে এসেছিলেন?’
আমি তাঁর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তার চোখেমুখে আশঙ্কা ফুঠে উঠল।
ম্যাকডোনাল্ড জেরা অব্যাহত রেখে বললেন, ‘আমি এ কথাও জানতে পেরেছি, তোমার ক্যাম্পে তোমার উদ্যোক্তার পয়সায় ক্যাপ্টেন স্যামুয়েল ও একজন নিরাপত্তা প্রহরী এবং একজন মুসলমান নারী রাঁধুনি নিয়োগ করেছ, এ সবই কি সত্যি?’
‘হ্যাঁ, সত্যি।’ আমার জবাব।
ম্যাকডোনাল্ডের জেরা—‘তুমি কি জান, যখন থেকে জানাজানি হয়েছে ম্যালকম এক্স তোমার ক্যাম্পে এসেছেন, তখন থেকে রটেছে যে কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানরা তোমাকে প্রভাবিত করেছে? ইতিমধ্যে এ লড়াই বিপর্যস্ত হয়েছে। আমার মুনাফা ফিরে পাওয়ার এখনো সুযোগ আছে এবং তার একটিমাত্র উপায়। তোমাকে আজ এখনই ঘর পরিষ্কার করতে হবে। প্রথমেই তোমার মুসলিম রাঁধুনিকে বাদ দিতে হবে, বাদ দিতে হবে নিরাপত্তা প্রহরীদের, ক্যাপ্টেন স্যামুয়েল এবং অন্যদের। তারপর আজ রাতেই বেতার ও টেলিভিশনে ঘোষণা করতে হবে যে তোমার সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি তোমাকে গণসংযোগের কাজের জন্য লোক দেব। তোমাকে বলতে হবে, তোমার সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। যা কিছু বলা হয়েছে সবকিছুই ভুল। তোমাকে ঘোষণা করতে হবে তুমি নির্দোষ বলে। তাহলেই আমরা কাজে এগিয়ে যেতে পারি।’ তিনি ফোন তুলে ডায়াল শুরু করলেন।
আমার প্রশ্ন—‘এবং যদি তা না করি?’
তিনি আমার দিকে চোখ তুললেন। আস্তে আস্তে ফোন রেখে দিলেন।
তিনি গম্ভীর হয়ে উঠলেন। চোখেমুখে কোনো ভাওতাবাজির চিহ্ন নেই। বললেন, ‘তুমি যদি না পার, তাহলে এ লড়াই হবে না। আমি স্থগিত রাখছি। তোমার জীবনটাই মাটি হয়ে যাবে। কিন্তু আমি জানি তুমি কাণ্ডজ্ঞানহীন নও। তুমি সারাটা জীবন ধরে যা চেয়েছ, তা মাটি করে দিতে পার না। এখনো শেষরক্ষার সময় আছে। আমি তোমাকে বলেছি, আমার গণসংযোগ বিভাগের লোক তোমাকে সাহায্য করবে। আজ সন্ধ্যায় তুমি টিভিতে যাও, তুমি বিশ্বকে জানিয়ে দাও যে তুমি কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমানদের কেউ নও। কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত না। বলো, তোমার সম্পর্কে ভুল ধারণা করা হয়েছে। বলে দাও, তুমি একজন সত্যিকার দেশপ্রেমিক অনুগত মার্কিন নাগরিক। তুমি সব সময় তাই ছিলে এবং থাকবেও। তবে এমন হতে পারে, তুমি ভালোভাবে না জেনে কোনো কিছুতে সইটই করেছ। তবে তাতে কিছু যায় আসে না। আমরা সংবাদ সম্মেলন ডাকব, সবকিছু পরিষ্কার করে দেব। আর তাহলেই লড়াই যথারীতি অনুষ্ঠিত হবে, এখনো যা জুয়াখেলার মতো হয়ে রয়েছে। কিন্তু ওই শর্তে লড়াই অনুষ্ঠিত হতে পারে।
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম, তাঁর দিকে তাকালাম। আমি মাথা নেড়ে বললাম, না আমি তা পারব না। শিরোপা লড়াইয়ের জন্য লিস্টনের মুখোমুখি হওয়ার যে সুযোগ আপনি দিয়েছেন, তার জন্য আমি কতৃজ্ঞ। আমি জানি লিস্টনকে আমি হারাতে পারব, আর তাই আমি চাই না লড়াই বন্ধ হয়ে যাক। কিন্তু আমার বিশ্বাসের জন্য যদি আপনাকে এ লড়াই স্থগিত রাখতে হয়, তবে তাই হোক।
ক্রিস উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘আমরা কেন এসব কিছু ভুলতে পারি না? লড়াইটা না হওয়া পর্যন্ত সবকিছুই ভুলতে হবে।’
ম্যাকডোনাল্ড চূড়ান্তভাবেই বললেন, ‘না, লড়াই হতে পারে না।’ তিনি ফোন তুলে রিং করলেন, বলে দিলেন, ‘এ লড়াই হবে না। সংবাদপত্রকে বলে দিন, সবাইকে জানিয়ে দিন এ লড়াই হবে না।’
তিনি ফোন ধরে থাকতে থাকতেই আমি দরজার কাছে চলে এলাম।

ক্রিস আমাকে ধরে রাখলেন। যেতে নিষেধ করলেন। আমি প্রোমোটরের মুখের দিক তাকালাম। আমি জানি তিনি কিংবা আমি কেউই মিথ্যা কথা বলছি না। আমার মাথা এমন ঝিমঝিম করছিল যে আমি আমার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সোজা জিমনেসিয়ামে চলে আসা পর্যন্ত কোনো কিছু বলতে পারিনি। আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে মিয়ামিতে বাসায় চলে এলাম গাড়ি চালিয়ে।

আমি ভেঙে পড়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম ম্যাকডোনাল্ড সত্যিই লড়াই বন্ধ করে দিতে চান। তিনি যা বলেছেন, সবকিছুই অর্থবোধক। কিন্তু আমি বাড়িতে আসতে না আসতেই ফোন বেজে উঠল। লাসভিলের একজন উদ্যোক্তা ওয়ার্থ বিংহাম ফোন করেছেন। তিনি জানতে পেরেছেন লড়াই হবে না।
‘শোন কেসিয়াস’, তিনি বললেন—‘তোমার দিককার ঘটনা আমি জানি, কিন্তু তুমি যা-ই কর না কেন, লড়াই বন্ধ হতে দিও না। ম্যাক তোমাকে কী করতে বলেন?’
আমি বলি, ‘তিনি আমাকে আমার ধর্ম অস্বীকার করতে বলেছেন এবং তার জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা করতে হবে।’
‘তবে তাই করো। কাজে নেমে পড়ো, তোমার তাতে ক্ষতি কী? তোমাকে এ ধরনের সুযোগ তারা আর দেবে না। ম্যাকডোনাল্ড এ লড়াই বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাকে তুমি কোনো সুযোগ দিও না।’
আমার জবাব, ‘আমি আমার ধর্মকে অস্বীকার করতে পারব না, মুষ্টিযুদ্ধের খাতিরেও নয়।’
‘তুমি আমার কথা শোনো, তোমার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে। কিন্তু তুমি যদি লড়াইয়ে জিতে যাও, তবে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। তুমি আমার উপদেশ যদি চাও, আমি বলব যে ম্যাকডোনাল্ড যা বলেন তুমি তা করো। তিনি সরে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছেন। তুমি তাঁকে সেই সুযোগ দিচ্ছ, কিন্তু তা দিও না। তাঁর পায়ের তলার মাটি তুমি কেড়ে নাও। জনসাধারণের সামনে তোমার ভাবমূর্তি তোমার ধর্ম নয়। তোমার মনে ঈশ্বর বৈ আর কী আছে তা কে জানবে? আমি তোমার আল্লাহর কথাই বলছি। তোমার ধর্মান্তর মাত্র কয়েক মাসের ঘটনা। আল্লাহ তা জানেন।’ এ কথা বলেই বিংহাম ফোন ছেড়ে দিলেন।

আমি নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম। কয়েক বছর পরে....আমি যখন এই মুহূর্তের কথা চিন্তা করি, আমি অনুভব করার চেষ্টা করি তখন আমার মনের অবস্থা কী ছিল। আমার মনে পড়ে, আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম। আমার ‘কয়েক মাসের ধর্মান্তরের’ ঘটনাকে তারা যা ভাবত, মুসলমান জাতির কাছে তার তাৎপর্য ছিল তার থেকেও বেশি। আমি চেয়েছিলাম দাসত্বের নাগপাশ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ জনসাধারণের মুক্তি, ন্যায়বিচার ও সমানাধিকার। এ কথা আমি আমার লাসভিল উদ্যোক্তা কিংবা ম্যাকডোনাল্ডকে কখনো বোঝাতে পারব না।

আমার সহযোগীদের অনেকেই ফোনে আমার কথাবার্তা শুনেছিল, তারা বুঝেছিল আমি কিসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। বান্দিনী (মহিলা রাঁধুনি) তখন দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘এখন কী করবেন, চ্যাম্পিয়ন?’
আমি বললাম, আমরা চলে যাচ্ছি। চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াই হবে না। বাক্স-প্যাটরা গোছাতে হবে।
‘বাড়ি যাওয়ার অর্থ কী?’
আমি বললাম, তোমরা কোনো টাকাপয়সা পাবে না।
সে বলল, ‘রসিকতা কর আর যাই কর, আমি টাকাপয়সা পাই আর না পাই, আমি চ্যাম্পিয়নের সঙ্গেই থাকব। স্যুটকেস গুছিয়ে নিই, রাস্তায় লড়াই দেখা যাবে।’
আমার কর্মচারীরা বাক্স-প্যাটরা গুছিয়ে বাসে গিয়ে উঠল।
আমি মাকে বললাম, লড়াই বন্ধ হয়ে গেছে। আমি বাড়ি ফিরে আসছি। আমি তার গলা শুনে বুঝলাম, তিনি ভেঙে পড়েছেন। আমাদের সবার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন যেন ভেঙে গেছে। আমার মুষ্টিযুদ্ধের জিনিসপত্র বোঝাই একটা বড় ভারী বাক্স নিয়ে যেতে আমি বান্দিনীকে সাহায্য করলাম। আমি ইঞ্জিনের কাছে বসলাম, চিন্তা করতে লাগলাম ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে হলো।

মোহাম্মদ আলী: সদ্যপ্রয়াত বিশ্ববিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা।

Comments

Popular posts from this blog

হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন না সম্রাট আওরঙ্গজেব

নিউজ এক্সপ্রেস ডেস্ক: মুঘল সম্রাটদের মধ্যে কেবল একজনই ভারতীয়দের মধ্যে স্থান করে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন - তিনি আলমগীর আওরঙ্গজেব। সাধারণ মানুষের মধ্যে আওরঙ্গজেবের ইমেজ হলো একজন ধর্মীয় গোঁড়া ব্যক্তি হিসেবে , যিনি হিন্দুদের ঘৃণা করতেন আর যিনি নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে এমনকি নিজের বড় ভাই দারা শিকোকে পর্যন্ত রেহাই দেননি। তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি বৃদ্ধ পিতাকে আগ্রার একটি দুর্গে তার জীবনের শেষ সাড়ে সাত বছর বন্দি করে রেখেছিলেন। সম্প্রতি পাকিস্তানী নাট্যকার শাহীদ নাদিম লিখেছেন যে ভারত ভাগের বীজ সত্যিকার অর্থে সেদিনই বপন করা হয়েছিল , যেদিন আওরঙ্গজেব তার ভাই দারাকে পরাজিত করেছিলেন। জওহরলাল নেহরুও ১৯৪৬ সালের প্রকাশিত তার বই ‘ ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া ’ তে আওরঙ্গজেবকে একজন গোঁড়া ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তবে মার্কিন ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রাশকা তার বই ‘ আওরঙ্গজেব - দ্যা ম্যান অ্যান্ড দ্যা মিথ ’ বইয়ে লিখেছেন যে আওরঙ্গজেব হিন্দুদের ঘৃণা করতেন আর তাই মন্দির ধ্বংস কর

দাঁড়িয়ে পানি পান কি ঠিক?

নিউজ এক্সপ্রেস ডেস্ক : সময় কিংবা অভ্যাসের কারণে আমরা অনেকেই দাঁড়িয়ে পানি পান করি। কিন্তু এই অভ্যাসের মাধ্যমে আমরা ডেকে আনছি বিপদ। একটা নয়, একগুচ্ছ রোগ বাসা বাঁধছে শরীরে। ভুগতে হচ্ছে কিডনি সমস্যায়। শরীরে পানির গুরুত্ব অনেক। কিন্তু ভুল নিয়মে পানি, বিশেষ করে রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে ঢকঢক করে পানি পানের অভ্যাসে শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রোগ- এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। দাঁড়িয়ে পানি পানের কুফল শরীরে টক্সিনের পরিমাণ বাড়ে: পানি পানের পরেই শরীরের ছাঁকনিগুলো শরীরকে পরিশ্রুত করার কাজ শুরু করে। দাঁড়িয়ে পানি পান করলে শরীরের ভিতরে থাকা ছাঁকনিগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। পরিশ্রুত করার কাজ বাধা পায়। ফলে, শরীরে টক্সিনের মাত্রা বাড়তে থাকে। পাকস্থলীতে ক্ষত: দাঁড়িয়ে পানি পান করলে তা সরাসরি পাকস্থলীতে গিয়ে আঘাত করে। পাকস্থলী থেকে নিঃসৃত অ্যাসিডের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বদহজমের আশঙ্কা বাড়ে। তলপেটে যন্ত্রণাসহ একাধিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। আর্থারাইটিসের আশঙ্কা: দাঁড়িয়ে পানি পান করলে শরীরের মধ্যে থাকা কিছু উপকারী রাসায়নিকের মাত্রা কমতে থাকে। ফলে হাড়ের জোড়ায় কর্মক্ষমতা কমে যায়। সেখান থেকে আর্থারাইটিসের আশ

হরিণের রাজ্যে

শাহনেওয়াজ খান আমরা দশ-বারোজন মিলে চারদিক থেকে ঘিরে ধরলাম হরিণের পালটাকে। ৬০-৭০টা হরিণ হবে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে পালটাকে ঘিরে ধরেছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আলো দ্রুত কমে যাচ্ছে। শেষ সময়, সুতরাং সবাই চারদিক দিয়ে এক নিঃশ্বাসে দৌড় দিলাম হরিণের পালকে আটকাতে। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য! আমার দু’পাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে হরিণ। এত জোরে দৌড়াচ্ছে যে পায়ের নিচের খুড়ের অংশগুলো ঠিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। হরিণের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ার ইচ্ছেটা শুরুতেই তো বড় বড় শিং দেখে মারা গিয়েছিল। এখন দৌড় দেখে উল্টো চুপসে গেলাম। মনে মনে প্রার্থনা শুরু করলাম, হে আল্লাহ, শিং বা খুরের আঁচড় যেন গায়ে না লাগে। বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে, এটা সুন্দরবন বা বিদেশি কোনো সাফারি পার্কের দৃশ্য? না, এটা আমাদের গর্ব নিঝুম দ্বীপের গল্প। খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলোর দ্বীপে যেখানে হরিণই চাঞ্চল্যের উৎস। তবে এই হরিণগুলো কিন্তু শুধু দ্বীপের পরিবেশকেই নয়, মানুষগুলোকেও ব্যস্ত রাখে। দল বেধে এসে নষ্ট করে দেয় ক্ষেতের ফসল। ২০০৯ সালের শুরুর দিকে শীত মৌসুমে গিয়েছিলাম নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স