শাহনেওয়াজ খান
মাস্টার্স
পরীক্ষা শেষে সিলেট যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। নাহিদ ও ইমরোজ কথা দিয়েছিল তারা অবশ্যই
যাবে। কিন্তু পরীক্ষা শেষে দেখা গেল সিলেট যাওয়ার বিষয়ে কেউ তেমন আগ্রহী নয়। এর
চেয়ে বরং কাছে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা। সিদ্ধান্ত হল বান্দরবান যাওয়া হবে। চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিলেটের তুলনায় বান্দরবান ভ্রমণের খরচ ঢের কম। তার উপর আছে
বান্দরবানের ছেলে মেহেদী, যে আবার পর্যটন ব্যবসার সাথে জড়িত। সুতরাং খরচ আরো কমবে।
নাহিদ তাই একটু দোটানা নিয়েই বলল, “দোস্ত চল বান্দরবানেই যাই। আসলে সিলেট যাওয়ার
মত টাকা এই মুহূর্তে সবার হাতে নেই।” সবার জন্য তাই নিজের ইচ্ছাকে আপাত বলি দিয়ে
বান্দরবান গেলাম (ভাইভার পর অবশ্য শিক্ষা সফর হিসেবে সিলেট যাওয়া হয়েছিল)। কিন্তু
ইমরোজকে ভ্রমণের জন্য রাজি করানো গেল না। আমার একগুঁয়েমিতাকে মনের মাঝেই রাখলাম।
সিলেটের কথা যেহেতু আগেই স্থির করেছি তাই সিদ্ধান্ত নিলাম বান্দরবান থেকে
চট্টগ্রাম এসে একাই সিলেট চলে যাব।
যেই কথা সেই কাজ। বান্দরবান থেকে ফিরে চট্টগ্রাম হয়ে সরাসরি চলে গেলাম সিলেট। সেখানে চাকরিসূত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী নেয়ামুল অবস্থান করছে। ফোনে যোগায়োগ করে গোটাটিকর পয়েন্টে ওর মেসে উঠলাম। মাধবকুণ্ড, জাফলং যাওয়ার ইচ্ছা আছে। কিন্তু ইউসেপের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কাজ করা নেয়ামুল রুট সম্পর্কে তেমন কিছু বলতে পারল না। তাই স্থানীয়রাই ভরসা। সকালে রুম থেকে বেরিয়ে একা একা দোকানদার ও আশেপাশের তরুণদের জিজ্ঞাসা করলাম। কিন্তু কি বিপদ কেউই যাওয়ার রাস্তা সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না! যাদের জিজ্ঞাসা করি সবাই বলে আমরা সিএনজি (সিএনজিচালিত অটোরিক্সা) বা মাইক্রোবাস রিজার্ভ করে গিয়েছিলাম। তাই উপায় না দেখে সরাসরি চলে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে। সেখানে ফলের দোকানদারদের কাছ থেকে মাধবকুণ্ডের রুট সম্পর্কে ধারণা নিলাম। এরপর বাসের কন্ডাক্টরদের জিজ্ঞাসা করে লোকাল বাসে বিয়ানীবাজারের রুট দিয়ে পৌঁছলাম বড়লেখা। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিক্সায় চড়ে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত। রাস্তার চারপাশজুড়ে অবস্থিত চা বাগানগুলোর সৌন্দর্য বেশ মনোমুগ্ধকর। জীবনে প্রথমবারের মত এত সুন্দর চা বাগান দেখে আমি এতটাই বিমোহিত যে অটোরিক্সা ছেড়ে রাস্তায় নেমে গেলাম। গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে একা একা ২০-৩০ মিনিট হেঁটে অবশেষে পৌঁছলাম আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। প্রায় ২০০ ফুট উঁচু জলপ্রপাত ও ইকোপার্ক বেশ মুগ্ধ করল। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে পাশে অবস্থিত আরেকটি ঝর্ণা ও আদিবাসীদের এলাকা ঘুরে আসলাম। তবে একা হওয়ায় বেশিক্ষণ ঘুরার সাহস পাই নি। বিকালে সাত রঙের চা (প্রকৃতপক্ষে পাঁচ রং ও সাত লেয়ারের চা) পান করলাম। ৭০ টাকা দাম দিয়ে যারপরনাই হতাশ। স্বাদ অনুযায়ী দামটা বেশি হলেও এতবার এই চায়ের কথা শুনেছি যে স্বাদ না নিলে কি যেন অপূর্ণ থাকত! এরপর আবারো অটোরিক্সায় চড়ে বড়লেখা। এবার অবশ্য আসলাম অন্য রুটে মৌলভীবাজার হয়ে।
পরদিন জাফলং যাওয়ার ইচ্ছা। তাই রাতে যথারীতি অন্যদের কাছে রুট সম্পর্কে তথ্য চাচ্ছি। এমন সময় আল-আমিনের ফোন। আমি কোথায় জিজ্ঞাসা করতেই বললাম সিলেট। ও জানাল, অফিসের কাজে ওরাও সিলেটে আসছে। দুই সহকর্মীসহ তিনজনের জন্য হোটেলে রুম দেখতে বলল। নেয়ামুলকে নিয়ে রুম ঠিক করলাম। রাতে ওরা আসার পর পরিকল্পনা হল পরদিন যাব দেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট (জলাবন- জলে নিমগ্ন বন) রাতারগুল। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই বৃষ্টি। বৃষ্টিস্নাত দিনে চা বাগানের সৌন্দর্যই অন্য রকম। তাই সিলেট শহরেই রাস্তার পাশে অবস্থিত চা বাগানগুলোতে নেমে পড়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। পাবলিক অটোরিক্সায় উঠলেও চালকের বিরক্তি দেখানো ছাড়া আর কিছু করার ছিল না! আম্বরখানা থেকে গোয়াইনঘাট যেতে সিএনজিচালিত অটোরিক্সা রিজার্ভ নিতে চাইলাম। কিন্তু রিজার্ভে গেলে ভাড়া বেশি। তাই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হিসেবে জনপ্রতি ভাড়ায় চলা অটোরিক্সায় উঠলাম। জনপ্রতি পড়ল ৭০ টাকা করে। গোয়াইনঘাট বাজারে নেমে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায় চড়ে গেলাম জলাবনটির কাছে। আগে থেকেই স্থানীয় এক ব্যক্তির সাথে কথা বলা ছিল। তার ছেলে আমাদের নৌকা দিয়ে রাতারগুল বনে নিয়ে গেল।
অসম্ভব সুন্দর এক বন। গাছগুলোর মূল অংশই পানির নিচে। শুধু পাতাসহ ডাল-পালাগুলোই পানির উপরে। ট্রলার ভাড়া করলে বনের ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না তাই নৌকাই উত্তম। বনের মধ্যে ঢুকতেই অন্য রকম এক অনুভূতি। সবুজ বনানীর মাঝে নৌকায় আমরা ক’জন! অবিশ্বাস্য! ঘন অরণ্যের মাঝে ছুটে চলছে নৌকা। কখনো মাথায়, কখনো পিঠে এসে লাগছে ডাল-পালা। শত চেষ্টা করেও তাদের ছোঁয়া এড়ানো যাচ্ছে না। এড়ানোটাও অবশ্য পুরোপুরি প্রয়োজনীয়ও নয়, কারণ এই ছোঁয়াতে যে জড়িয়ে আছে রোমাঞ্চ! গহীন অরণ্যের ভেতরে ঢুকামাত্র হারিয়ে ফেললাম সূর্যকে। শুনলাম এদিককার বনের অনেক অংশেই সূর্যের আলো পৌঁছায় না। অরণ্যের গভীরতা আরো উপভোগ্য হল নানা রঙের পাখির কিচির-মিচির ও বানরের লাফালাফিতে। মাথার উপর দিয়ে এক গাছের ডাল থেকে অন্য গাছের ডালে যাচ্ছে বানর। আর চেয়ে চেয়ে দেখছে আমাদের। তবে আগন্তুকদের আগমনে ওরা তেমন একটা শঙ্কিত নয়, এটা ওদের ভাব-ভঙ্গীতেই স্পষ্ট। যথারীতি সাপের দেখাও পেলাম। পানির উপর চিকন ডালে পেঁচিয়ে থাকা সবুজ সাপের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য অবলোকনের ইচ্ছা ও ভীতিটা প্রথম থেকেই ছিল। রাতারগুল এটা থেকেও আমাদের বঞ্চিত করল না। সাপের ব্যাঙ শিকারের দৃশ্য দেখার সৌভাগ্যও হল। কিন্তু আফসোস ক্যামেরাম্যান ভিডিও করার আগেই ব্যাঙ-ভক্ষণ পর্বের সমাপ্তি। ভিডিও করতে না পারলেও শুরুতে ব্যাঙের একটা ছবি তুলতে পারার স্বস্তি অবশ্য আছে।
ডাল-পালার ফাঁকফোঁকর গলে নৌকা নিয়ে যাচ্ছি অথচ দু-একটা ডালে চড়ব না এটা কি হয়! অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ যুৎসই এক ডাল পাওয়া গেল। সিদ্ধান্ত হল একজন একজন করে উঠব। প্রথমজন উঠে দু-একটা ছবি তুলতেই চোখে পড়ল ডালের নিচের অংশে অসংখ্য বিছা (শুককীট)। ভয়ে ওই ডালের কাছ থেকে দ্রুত কেটে পড়লাম। অন্য ডালে উঠার ইচ্ছাটা দুই সঙ্গীর প্রবল বিরোধিতায় বাতিল করতে হল। বনের মাঝে মাঝে বেশ সুন্দর খোলা স্থানও আছে। চারদিকে গাছ-পালা মাঝে পানি, উপরে নীল আকাশ- প্রকৃতি বোধ হয় ভ্রমণপিপাসুদের জন্যই স্থানগুলো সাজিয়ে রেখেছে! এ ধরনের এক স্থানে মিলল শাপলা ফুলও। সাথে বাড়তি পাওনা ছিল শাপলার ফল/দানা (যা স্থানীয় ভাষায় ভ্যাট নামে পরিচিত)। পানি থেকে টপাটপ কয়েকটা ভ্যাট তুলে খেলাম। অনেক দিন পর এত বড় ভ্যাট খাওয়ার সৌভাগ্য হল। সময়ের কাছে মানুষ বড়ই অসহায়। আমাদেরও সময় শেষ হয়ে এল। বিকালের আগেই বন থেকে বের হয়ে সিলেটে ফিরতে হবে। বনের অন্য পাশ দিয়ে বেরুনোর পর ভারতীয় অংশের বিশাল বিশাল পাহাড় ও ঝর্ণা দেখে চোখে জুড়াল। মাঝি আঙুল দিয়ে দেখালেন জাফলংয়ের অবস্থানও। বললেন এখান থেকে ট্রলারে করে যাওয়া যায়। এরই ফাঁকে পাহাড়ের কোলে লেগে থাকা মেঘগুলো চমৎকারভাবে ধরা দিল। বর্ষাকাল হওয়ায় বোধ করি মেঘের আনাগোনা ও সৌন্দর্য অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছিল। এই রাতারগুলই কিন্তু শীতকালে অন্যরূপ ধারণ করে। বনের কোথাও পানি থাকে না। গাছের ডাল ও পাতাগুলো শুষ্ক হয়ে ঝড়ে পড়ে। তবে কিছু কিছু গাছে অবশ্য পাতা থাকে, থাকে ফুলও। সে সময় অন্য সৌন্দর্যে ধরা দেয় এই বন। যার সঙ্গে বর্ষার সৌন্দর্যের কোনো মিল নেই।
গ্রামের কাছের অংশে পানি অনেক কম, টাখনুর কিছুটা উপরে। কোথাও কোথাও অবশ্য হাঁটুর কাছাকাছি। এই অংশে নৌকা ভিড়তে পারে না, তাই নেমে হাঁটতে হয়। নৌকায় উঠার সময়ও এটুকু পথ হেঁটে এসেছি। তবে তখন এই রাস্তাটা আমাদের কাছে আনন্দদায়ক ছিল। কিন্তু যাওয়ার সময় এই পানিতে জোঁক থাকার তথ্য জানার পরই আনন্দ পরিণত হল ভয়ে। তবে জোঁককে পানিতে রেখেই অক্ষত অবস্থায় ডাঙায় ফেরার পর আনন্দানুভূতিটা পূর্ণরূপেই ধরা দিল। মাঝির চাওয়া অনুযায়ী ৩০০ টাকা দিতে গিয়ে তাই সেটাকে অনেক কম মনে হল। অনুরোধ সত্ত্বেও মাঝিদের বাড়িতে বেশি সময় কাটাতে পারলাম না। আমাদের দ্রুত ফিরতে হবে সিলেটে। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়ার পর রাতের মধ্যেই মৌলভীবাজার হয়ে যাব শ্রীমঙ্গল। পরদিনই যে আবার হাম হাম অভিযানে নেমে পড়তে হবে!
যেই কথা সেই কাজ। বান্দরবান থেকে ফিরে চট্টগ্রাম হয়ে সরাসরি চলে গেলাম সিলেট। সেখানে চাকরিসূত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী নেয়ামুল অবস্থান করছে। ফোনে যোগায়োগ করে গোটাটিকর পয়েন্টে ওর মেসে উঠলাম। মাধবকুণ্ড, জাফলং যাওয়ার ইচ্ছা আছে। কিন্তু ইউসেপের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কাজ করা নেয়ামুল রুট সম্পর্কে তেমন কিছু বলতে পারল না। তাই স্থানীয়রাই ভরসা। সকালে রুম থেকে বেরিয়ে একা একা দোকানদার ও আশেপাশের তরুণদের জিজ্ঞাসা করলাম। কিন্তু কি বিপদ কেউই যাওয়ার রাস্তা সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না! যাদের জিজ্ঞাসা করি সবাই বলে আমরা সিএনজি (সিএনজিচালিত অটোরিক্সা) বা মাইক্রোবাস রিজার্ভ করে গিয়েছিলাম। তাই উপায় না দেখে সরাসরি চলে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে। সেখানে ফলের দোকানদারদের কাছ থেকে মাধবকুণ্ডের রুট সম্পর্কে ধারণা নিলাম। এরপর বাসের কন্ডাক্টরদের জিজ্ঞাসা করে লোকাল বাসে বিয়ানীবাজারের রুট দিয়ে পৌঁছলাম বড়লেখা। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিক্সায় চড়ে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত। রাস্তার চারপাশজুড়ে অবস্থিত চা বাগানগুলোর সৌন্দর্য বেশ মনোমুগ্ধকর। জীবনে প্রথমবারের মত এত সুন্দর চা বাগান দেখে আমি এতটাই বিমোহিত যে অটোরিক্সা ছেড়ে রাস্তায় নেমে গেলাম। গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে একা একা ২০-৩০ মিনিট হেঁটে অবশেষে পৌঁছলাম আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। প্রায় ২০০ ফুট উঁচু জলপ্রপাত ও ইকোপার্ক বেশ মুগ্ধ করল। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে পাশে অবস্থিত আরেকটি ঝর্ণা ও আদিবাসীদের এলাকা ঘুরে আসলাম। তবে একা হওয়ায় বেশিক্ষণ ঘুরার সাহস পাই নি। বিকালে সাত রঙের চা (প্রকৃতপক্ষে পাঁচ রং ও সাত লেয়ারের চা) পান করলাম। ৭০ টাকা দাম দিয়ে যারপরনাই হতাশ। স্বাদ অনুযায়ী দামটা বেশি হলেও এতবার এই চায়ের কথা শুনেছি যে স্বাদ না নিলে কি যেন অপূর্ণ থাকত! এরপর আবারো অটোরিক্সায় চড়ে বড়লেখা। এবার অবশ্য আসলাম অন্য রুটে মৌলভীবাজার হয়ে।
পরদিন জাফলং যাওয়ার ইচ্ছা। তাই রাতে যথারীতি অন্যদের কাছে রুট সম্পর্কে তথ্য চাচ্ছি। এমন সময় আল-আমিনের ফোন। আমি কোথায় জিজ্ঞাসা করতেই বললাম সিলেট। ও জানাল, অফিসের কাজে ওরাও সিলেটে আসছে। দুই সহকর্মীসহ তিনজনের জন্য হোটেলে রুম দেখতে বলল। নেয়ামুলকে নিয়ে রুম ঠিক করলাম। রাতে ওরা আসার পর পরিকল্পনা হল পরদিন যাব দেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট (জলাবন- জলে নিমগ্ন বন) রাতারগুল। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই বৃষ্টি। বৃষ্টিস্নাত দিনে চা বাগানের সৌন্দর্যই অন্য রকম। তাই সিলেট শহরেই রাস্তার পাশে অবস্থিত চা বাগানগুলোতে নেমে পড়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। পাবলিক অটোরিক্সায় উঠলেও চালকের বিরক্তি দেখানো ছাড়া আর কিছু করার ছিল না! আম্বরখানা থেকে গোয়াইনঘাট যেতে সিএনজিচালিত অটোরিক্সা রিজার্ভ নিতে চাইলাম। কিন্তু রিজার্ভে গেলে ভাড়া বেশি। তাই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হিসেবে জনপ্রতি ভাড়ায় চলা অটোরিক্সায় উঠলাম। জনপ্রতি পড়ল ৭০ টাকা করে। গোয়াইনঘাট বাজারে নেমে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায় চড়ে গেলাম জলাবনটির কাছে। আগে থেকেই স্থানীয় এক ব্যক্তির সাথে কথা বলা ছিল। তার ছেলে আমাদের নৌকা দিয়ে রাতারগুল বনে নিয়ে গেল।
অসম্ভব সুন্দর এক বন। গাছগুলোর মূল অংশই পানির নিচে। শুধু পাতাসহ ডাল-পালাগুলোই পানির উপরে। ট্রলার ভাড়া করলে বনের ভেতরে প্রবেশ করা যাবে না তাই নৌকাই উত্তম। বনের মধ্যে ঢুকতেই অন্য রকম এক অনুভূতি। সবুজ বনানীর মাঝে নৌকায় আমরা ক’জন! অবিশ্বাস্য! ঘন অরণ্যের মাঝে ছুটে চলছে নৌকা। কখনো মাথায়, কখনো পিঠে এসে লাগছে ডাল-পালা। শত চেষ্টা করেও তাদের ছোঁয়া এড়ানো যাচ্ছে না। এড়ানোটাও অবশ্য পুরোপুরি প্রয়োজনীয়ও নয়, কারণ এই ছোঁয়াতে যে জড়িয়ে আছে রোমাঞ্চ! গহীন অরণ্যের ভেতরে ঢুকামাত্র হারিয়ে ফেললাম সূর্যকে। শুনলাম এদিককার বনের অনেক অংশেই সূর্যের আলো পৌঁছায় না। অরণ্যের গভীরতা আরো উপভোগ্য হল নানা রঙের পাখির কিচির-মিচির ও বানরের লাফালাফিতে। মাথার উপর দিয়ে এক গাছের ডাল থেকে অন্য গাছের ডালে যাচ্ছে বানর। আর চেয়ে চেয়ে দেখছে আমাদের। তবে আগন্তুকদের আগমনে ওরা তেমন একটা শঙ্কিত নয়, এটা ওদের ভাব-ভঙ্গীতেই স্পষ্ট। যথারীতি সাপের দেখাও পেলাম। পানির উপর চিকন ডালে পেঁচিয়ে থাকা সবুজ সাপের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য অবলোকনের ইচ্ছা ও ভীতিটা প্রথম থেকেই ছিল। রাতারগুল এটা থেকেও আমাদের বঞ্চিত করল না। সাপের ব্যাঙ শিকারের দৃশ্য দেখার সৌভাগ্যও হল। কিন্তু আফসোস ক্যামেরাম্যান ভিডিও করার আগেই ব্যাঙ-ভক্ষণ পর্বের সমাপ্তি। ভিডিও করতে না পারলেও শুরুতে ব্যাঙের একটা ছবি তুলতে পারার স্বস্তি অবশ্য আছে।
ডাল-পালার ফাঁকফোঁকর গলে নৌকা নিয়ে যাচ্ছি অথচ দু-একটা ডালে চড়ব না এটা কি হয়! অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ যুৎসই এক ডাল পাওয়া গেল। সিদ্ধান্ত হল একজন একজন করে উঠব। প্রথমজন উঠে দু-একটা ছবি তুলতেই চোখে পড়ল ডালের নিচের অংশে অসংখ্য বিছা (শুককীট)। ভয়ে ওই ডালের কাছ থেকে দ্রুত কেটে পড়লাম। অন্য ডালে উঠার ইচ্ছাটা দুই সঙ্গীর প্রবল বিরোধিতায় বাতিল করতে হল। বনের মাঝে মাঝে বেশ সুন্দর খোলা স্থানও আছে। চারদিকে গাছ-পালা মাঝে পানি, উপরে নীল আকাশ- প্রকৃতি বোধ হয় ভ্রমণপিপাসুদের জন্যই স্থানগুলো সাজিয়ে রেখেছে! এ ধরনের এক স্থানে মিলল শাপলা ফুলও। সাথে বাড়তি পাওনা ছিল শাপলার ফল/দানা (যা স্থানীয় ভাষায় ভ্যাট নামে পরিচিত)। পানি থেকে টপাটপ কয়েকটা ভ্যাট তুলে খেলাম। অনেক দিন পর এত বড় ভ্যাট খাওয়ার সৌভাগ্য হল। সময়ের কাছে মানুষ বড়ই অসহায়। আমাদেরও সময় শেষ হয়ে এল। বিকালের আগেই বন থেকে বের হয়ে সিলেটে ফিরতে হবে। বনের অন্য পাশ দিয়ে বেরুনোর পর ভারতীয় অংশের বিশাল বিশাল পাহাড় ও ঝর্ণা দেখে চোখে জুড়াল। মাঝি আঙুল দিয়ে দেখালেন জাফলংয়ের অবস্থানও। বললেন এখান থেকে ট্রলারে করে যাওয়া যায়। এরই ফাঁকে পাহাড়ের কোলে লেগে থাকা মেঘগুলো চমৎকারভাবে ধরা দিল। বর্ষাকাল হওয়ায় বোধ করি মেঘের আনাগোনা ও সৌন্দর্য অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছিল। এই রাতারগুলই কিন্তু শীতকালে অন্যরূপ ধারণ করে। বনের কোথাও পানি থাকে না। গাছের ডাল ও পাতাগুলো শুষ্ক হয়ে ঝড়ে পড়ে। তবে কিছু কিছু গাছে অবশ্য পাতা থাকে, থাকে ফুলও। সে সময় অন্য সৌন্দর্যে ধরা দেয় এই বন। যার সঙ্গে বর্ষার সৌন্দর্যের কোনো মিল নেই।
গ্রামের কাছের অংশে পানি অনেক কম, টাখনুর কিছুটা উপরে। কোথাও কোথাও অবশ্য হাঁটুর কাছাকাছি। এই অংশে নৌকা ভিড়তে পারে না, তাই নেমে হাঁটতে হয়। নৌকায় উঠার সময়ও এটুকু পথ হেঁটে এসেছি। তবে তখন এই রাস্তাটা আমাদের কাছে আনন্দদায়ক ছিল। কিন্তু যাওয়ার সময় এই পানিতে জোঁক থাকার তথ্য জানার পরই আনন্দ পরিণত হল ভয়ে। তবে জোঁককে পানিতে রেখেই অক্ষত অবস্থায় ডাঙায় ফেরার পর আনন্দানুভূতিটা পূর্ণরূপেই ধরা দিল। মাঝির চাওয়া অনুযায়ী ৩০০ টাকা দিতে গিয়ে তাই সেটাকে অনেক কম মনে হল। অনুরোধ সত্ত্বেও মাঝিদের বাড়িতে বেশি সময় কাটাতে পারলাম না। আমাদের দ্রুত ফিরতে হবে সিলেটে। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়ার পর রাতের মধ্যেই মৌলভীবাজার হয়ে যাব শ্রীমঙ্গল। পরদিনই যে আবার হাম হাম অভিযানে নেমে পড়তে হবে!
Comments
Post a Comment