Skip to main content

জলাবন ও হাম হাম রোমাঞ্চ (পর্ব-২)

শাহনেওয়াজ খান



রাতারগুল থেকে সিলেট শহরে ফিরে খুব একটা সময় নিলাম না। ঝটপট প্রস্তুত হয়ে উঠলাম বাসে। প্রথমে ইচ্ছা ছিল মৌলভীবাজার নামার। কিন্তু জানলাম, মৌলভীবাজার সদর থেকে শ্রীমঙ্গল খুব কাছে। সর্বোচ্চ ৩০ মিনিটের রাস্তা। তাই মৌলভীবাজার সদরে না নেমে সরাসরি শ্রীমঙ্গল চলে গেলাম। গিয়েই প্রথমে হোটেলের সন্ধান করলাম। প্রধান সড়কের পাশেই হোটেলে রুম ঠিক করে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাতে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম রেল স্টেশনের ‍কাছে। সেখানে স্থানীয়দের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম কাছেই বিজিবির ক্যাম্প ও মার্কেট আছে। রাতের খাবারের আগে বেশ সময় আছে আমাদের হাতে, তাই সোজা চলে গেলাম সেখানে। ওখানে গিয়ে সাত রঙের চায়ের সন্ধান পেলাম। দোকানির কাছে জানতে পারলাম তিনিই নাকি এই চায়ের উদ্ভাবক। তার আর কোনো দোকান নেই। তার কাছ থেকে শিখেই অনেকে নানা জায়গায় দোকান দিয়েছে। কিন্তু তিনি জোর দিয়েই বললেন, তার মত করে আর কেউ এই চা বানাতে পারে না। সাথে সাথে মনে পড়ল মাধবকুণ্ডে কি তবে তার শিষ্য কারো হাতেই খেয়েছি? প্রশ্নটা করতেই তিনি তাকে নিয়ে হওয়া পত্রিকার সংবাদের কপি দেখালেন। পাশাপাশি বললেন এই রেসিপি সাপ্লাইয়ের জন্য তাকে মোটা অঙ্কের অর্থের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাতে সাড়া দেননি। গোপন কক্ষে গিয়ে চা বানানো ও পান করার ফাঁকে তিনি আমাদের সাথে বেশ গল্প শুরু করলেন। আমরাও উপভোগ করতে থাকলাম। এক পর্যায়ে তিনি জানতে চাইলেন আগামীকাল আমরা কোথায় যাব। আমরা বললাম, ভোরে উঠে ফজরের নামাজের পরপরই ছুটব হাম হাম ঝর্ণার উদ্দেশে। হাম হামের কথা শুনেই তিনি রুট সম্পর্কে বলা শুরু করলেন। কিন্তু আমাদের জানা রুটের সাথে তার বর্ণনা মেলে না। তাই তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি ওখানে গিয়েছেন? তিনি বললেন, না। তবে তার ছেলে নাকি কয়েক দিন আগে গিয়েছিল। তিনি বর্ণনা করেই চলছেন, কি এক ভয়ানক জায়গা। পাহাড় জুড়ে সাপ আর জোঁক। পানি কোথাও কোথাও কোমর বা বুক পর্যন্ত। কোথাও হাঁটু পর্যন্ত কাঁদা। যেতে আসতে সময় লাগে ১০-১২ ঘণ্টা। অনেক সময় ফিরতে রাত হয়ে যায়। সেখানে রাত কাটানোর জায়গা না থাকায় অভিযাত্রীদের পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। সর্বোপরি খুবই বিপজ্জনক ও দুর্গম এলাকা। তার ছেলে তো সেখান থেকে এসে কয়েক দিন জ্বরে ভুগেছিল। তিনি তাই আমাদের সেখানে না যাওয়ার জন্য বারবার সাবধান করতে লাগলেন।

জায়গাটা দুর্গম সেটা আমরা জানি। কিন্তু লোকটার বর্ণনা শুনে অনেকটা অতিরঞ্জিত মনে হল। এমন হলে তো সচরাচর কারো যাওয়ারই কথা নয়। তার উপর সেখানে না গিয়েই যেভাবে রুটের বর্ণনা দিয়েছিলেন তাতে তার কথায় আস্থা রাখতে পারলাম না। উনার কথাগুলো অনেকটা বাড়িয়ে বলা গাল-গল্পের পর্যায়েই ফেললাম। কিন্তু আমাদের এক সঙ্গী (আল-আমিনের সহকর্মী) নওফেল উনার কথাগুলোকে সত্য বলে ধরে নিলেন এবং বেশ ভয় পেলেন। তিনি বারবার বলতে লাগলেন, ভাই চলেন ওখানে না গিয়ে আমরা অন্য কোথাও যাই। কিন্তু আমরা তার কথাকে তেমন পাত্তা দিলাম না। হাম হাম যাওয়ার উদ্দেশ্যে যখন এসেছি, তখন সেখানে যাবই। কিন্তু নওফেল ভাই যে সত্যি সত্যি অনেক ঘাবড়ে গেছেন তা বুঝতে পারলাম খাবার খেয়ে হোটেলে ফেরার পর। তিনি এবার কয়েক মিনিট ফোনে কথা বলে জানালেন, বাড়িতে অনেক সমস্যা হচ্ছে তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। আসলে ঘটনা কি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি খোলাসা করে কিছু বললেন না। পারিবারিক সমস্যা অল্পতেই মিটে যাবে বলে বুঝানোর পর তিনি তার প্রেমিকার সাথে ঝামেলা হচ্ছে এমন কথাও বললেন। অনেক বুঝিয়েও তাকে থাকার ব্যাপারে রাজি করানো যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে তিনি কান্নাভেজা চোখে তাকে বাসে উঠিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। অগত্যা তাকে শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকার বাসে উঠিয়ে দিলাম। পরদিন দুপুরেই অবশ্য জানা গিয়েছিল বাসায় তেমন কোনো ঝামেলা হয় নি, সমাধান হয়ে গেছে!



একজন চলে যাওয়ায় অভিযাত্রী দাঁড়ালাম মোট তিনজনে। আগেই জিপের ব্যাপারে কথা বলা ছিল। আসা-যাওয়া বাবদ যতদূর মনে পড়ে ১২০০ টাকার মতো ভাড়া নিয়েছিল। প্রায় ১০-১২ জন যাওয়া যায় ওই জিপে। কিন্তু আমরা মাত্র তিনজন হওয়ায় প্রত্যেকের ভাগে ভাড়ার অঙ্কটা একটু বেশিই পড়ল। শ্রীমঙ্গলের বড় বড় চা বাগান, চায়ের যাদুঘর, লাউয়াছড়া ইকোপার্ক- সব দেখতে দেখতে ছুটছি কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত হাম হামের উদ্দেশে। মনিপুরী পল্লী পেরিয়ে মাঝে নো-ম্যানস ল্যান্ড দিয়ে পা রাখি ভারতের সীমানায়। পরক্ষণেই সাবধান বাণীতে ফিরে আসা। ঝর্ণার এলাকার কাছাকাছি এসে কাঁদাময় রাস্তায় কিছুটা ভোগান্তি হলেও অনেকটা ভালভাবেই গন্তব্যে পৌঁছাই। সেখানে যাওয়া মাত্র আমাদের ঘিরে ধরে কয়েক শিশু। তাদের সবার হাতেই লাঠি। জানতে পারলাম, হাম হামে যাওয়ার পথ পুরোটাই পাহাড়ি। পথে বৃষ্টি হবেই। কাঁদামাখা রাস্তায় লাঠি ছাড়া উঠানামা করা দুষ্কর। তাই লাঠি অবশ্য প্রয়োজন। পাঁচ টাকা করে একেকটা বাঁশের লাঠি নিলাম। কলা, রুটি, কয়েক লিটার পানি ও স্যালাইন নিয়ে নিলাম। কাঁদায় পিচ্ছিল পথে আমি আর জাহিদ ভাই খালি পায়ে রওয়ানা হলাম। আগের রাতে শ্রীমঙ্গল থেকে কেনা প্লাস্টিকের জুতাগুলো গাড়িতেই রইল। ৩০০ টাকার বিনিময়ে স্থানীয় গাইড নিয়ে শুরু হল আমাদের যাত্রা।

ভারত-সীমান্ত সংলগ্ন পাহাড়ি বনাঞ্চল। বন বিভাগের আওতাধীন এই এলাকায় রয়েছে বিভিন্ন মূল্যবান উদ্ভিদ ও পশু-পাখি। স্থানীয়রা জানালেন, গহীন অঞ্চলে রয়েছে একাধিক ঝর্ণা, কিন্তু ওগুলোতে যাওয়ার পথ নেই। রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কুরমা বন বিট এলাকায় অবস্থিত হাম হামের পথই তো আবিষ্কৃত হয় ২০১০ সালে। বৃষ্টিভেজা সকালে পাহাড়ে উঠার আগেই সাক্ষাৎ হল জোঁকের সাথে। যে ঘাস মাড়িয়ে যাচ্ছি সেগুলোর উপরে লাফাচ্ছে ছোট ছোট অসংখ্য জোঁক! তবে আকারে ছোট হওয়ায় সেগুলো আমাদের মনে তেমন একটা ভয় ধরাতে পারল না। তবে জাহিদ ভাই ভয় পেলেন যথেষ্ট। তার একটাই কথা- জোঁক কি শরীরের ভেতর ঢুকে যায়? আমরা আশ্বস্ত করলাম- শরীরের ভেতরে নয়, এটা বাইরে থেকেই রক্ত চুষে খায়। পাহাড়ি রাস্তায় উঠতেই গাইড সতর্ক করে দিলেন। পুরো ৪-৫ মাইলের পথ, যাওয়া-আসায় মোট ৮-১০ মাইল হাঁটতে হবে। এ সময়ে কোথাও বিশ্রাম নেওয়ার তেমন জায়গা পাওয়া যাবে না। কারণ, আমরা যে রাস্তা ধরে হাঁটছি তা পায়ে চলার। পায়ে হাঁটার জায়গাটুকু মাটির; এই মাটির দু’পাশে যে ঘাস আছে সেগুলোতে রয়েছে ‍অসংখ্য জোঁক। এমনকি চারদিকে বেষ্টিত গাছ-পালাগুলোতেও রয়েছে নানা ধরনের জোঁক। ভয়ে চুপসে আসার মত তথ্য। এর চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর তথ্যটা দিলেন তিনি তারপর। বললেন, এখানে আসার আগে সবাই গায়ে এক ধরনের তেল মেখে আসে যাতে জোঁক না ধরে। কিন্তু আমরা তো ওই তেল মাখি নি! তিনি বললেন, আসার পথে যে জায়গায় স্থানীয়রা ওই তেল বিক্রি করে আমাদের গাড়ি সেই রাস্তায় না এসে অন্য রাস্তা দিয়ে এসেছে। ড্রাইভারের উপর প্রচণ্ড রাগ নিয়েই শুরু হল অভিযান। পাহাড়ি পথে উঠতে লাঠিগুলো ভালই কাজে দিল। শুধু পাহাড়ে উঠা, আর নামা। কোথাও সমতল ভূমি নেই। লাঠিতে ভর না দিয়ে এই পাহাড়ি কাঁদামাখা রাস্তায় চলাটা বেশ দুষ্কর। এমনকি স্থানীয়দের পক্ষেও এটা সম্ভব নয়, বিশেষত বৃষ্টির পর। পাহাড়ে উঠতে-নামতে গিয়ে দু-একটা বানর ও বেশ কয়েক প্রজাতির পাখি চোখে পড়ল। অসম্ভব ভাল লাগল পাহাড়ি হ্রদ। পাহাড়গুলোর মাঝ দিয়ে বয়ে চলা বিশালাকার স্বাদু পানির হ্রদটি সত্যিই মনোমুগ্ধকর। হ্রদের উপর দিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটা সাঁকো তৈরি করে দিয়েছে বন বিভাগ। এদিকে একটানা উঠানামায় ক্লান্ত হয়ে পড়ছি, তার উপর প্রচণ্ড পানি পিপাসা। তাই ক্ষণিক পর পর পানি ও স্যালাইন খাওয়া। একটি পাহাড়ের উপর কিছুটা খালি জায়গা পাওয়ায় রুটি-কলা খেয়ে নিলাম। হালকা বিশ্রাম নিয়েই আবার ছুটে চলা। প্রবাদ আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। জাহিদ ভাই জোঁক নিয়ে অনেক বেশি ভয় পাচ্ছিলেন, অথচ তার সাথেই দু-তিনবার জোঁকের সাক্ষাৎ হল! পায়ে তো আছেই একবার গাছ থেকে জোঁক পড়ল সোজা তার ঘাড়ে। সৌভাগ্য যে প্রতিবারই জোঁকের উপস্থিতি টের পাওয়া গেছে। একবারও সেটা রক্ত চোষা শুরু করতে পারে নি।



কাঁদা মাখা পথে হাঁটার সময় খালি পায়ে থাকার উপকারিতাটা টের পাচ্ছিলাম। কেডস পরে থাকা আল-আমিনের হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। সিলেট মানেই যখন-তখন বৃষ্টি। চলার মাঝে বৃষ্টি হওয়ায় আল-আমিনের অবস্থা আরো খারাপ হল। পাহাড়ি এই গহীন বনাঞ্চলের অনেক স্থানে কখনোই সূর্যের আলো পৌঁছায় না। তাই ওই স্থানগুলো প্রায় সবসময়ই কাঁদামাখা থাকে। এরই মাঝে এসে পড়লাম পাথরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পানির পথে। পানি টাখনু পর্যন্ত, হেঁটে যেতে তেমন একটা সমস্যা নেই। কিন্তু ভয় একটাই- জোঁক। গাইড জানালেন, আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, চারদিকে জোঁকের জয়-জয়কার হলেও এই পানিতে কোনো জোঁক নেই। পাথুরে রাস্তা হওয়ায় খালি পায়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। এবার অবশ্য আল-আমিনের জিত। কেডস থাকায় সে অতি সহজেই রাস্তা পার হচ্ছে। কিন্তু আমাদের পা ফেলতে হচ্ছে সাবধানে। একটু এদিক-সেদিক হলেই পা ফসকে যাবে। আবারো বৃষ্টি, এবার শুরু হল মুষলধারে। সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেল পানি। ঢলের মত পানি আসছে। দেখতে দেখতে হাঁটু ছাড়িয়ে কোমর অব্দি পানিতে ডুবে গেল। আমাদের হাঁটতে হচ্ছে স্রোতের বিপরীতে। অনেক কষ্টে ১৫-২০ মিনিটের রাস্তা পেরুলাম ৪০-৪৫ মিনিটে। ভাগ্যিস তবু পাহাড়ি ঢল নামার আগেই রাস্তা শেষ করতে পেরেছি। বেশ ঘন জঙ্গলের মত একটা এলাকা পেরুতেই ঝর্ণার পানি পড়ার শব্দ। শব্দের দিকে কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই দেখা মিলল আকাক্ষিত হাম হাম জলপ্রপাতের। বৃষ্টি হওয়ায় পানি অনেক বেশি। বেশি সৌন্দর্যও। সবচেয়ে সুন্দর লাগল পাহাড়ের মাঝে খাঁজ থাকায়। ঝর্ণার পানি সরাসরি নিচে না পরে খাঁজে গিয়ে আঘাত হানছে। তারপর আবার ছড়িয়ে পড়ছে নিচে। আল্লাহ তায়ালার অপরূপ সৃষ্টি! প্রথম দেখাতেই যারপরনাই মুগ্ধ। এর আগে অনেক ঝর্ণা দেখলেও খাঁজে ভেঙ্গে আসা এত বিশাল আকারের ঝর্ণা কখনো দেখি নি। ঝর্ণাটি উচ্চতায় মাধবকুণ্ডের চেয়ে কম হলেও প্রশস্ততার দিক থেকে এটির চেয়ে দুই-তিনগুণ বড়। ঝর্ণার পানিতে গোসলে নামলাম। তবে পানির স্রোত খুব বেশি থাকায় কাছে যাওয়া সম্ভব হল না। বেশি ছবি তোলাও গেল না। কারণ, ক্যামেরা ও মোবাইল উভয়ের চার্জই শেষ! গোসল শেষে একবার ভাবনা এল এখানে রাত কাটানো যায় কি না। কিন্তু সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই।

হাম হাম ঝর্ণা দেখে ফেরার পালা। খাবার ও পানি যা এনেছিলাম তা আসতে আসতেই শেষ। যাওয়ার সময় কি হবে? দুশ্চিন্তা নিয়েই দ্রুত হাঁটা দিলাম। একে তো ভেজা গা তার উপর বৃষ্টি। তাও স্বস্তি বৃষ্টিতে ভেজার কারণে পানির তেষ্টাটা লাগছে না। গাইড তাড়া দিলেন দ্রুত ফেরার। যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে পাহাড়ি ঢল নামার শঙ্কা রয়েছে। আর ঢল নামলে পাহাড়েই রাত কাটাতে হবে। সুতরাং দ্রুত হাঁটা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। দ্রুত হেঁটে পানির রাস্তা পার হয়ে পাহাড়ে উঠে একটু বিশ্রাম নিলাম। এখানে দেখা মিলল শুঁড়ওয়ালা অদ্ভুত এক জোঁকের। আমার প্যান্টের উপর সেটা লাফাচ্ছিল। কাঠি দিয়ে সেটাকে সরিয়ে কিছুটা তেষ্টা নিয়েই আবার পথচলা। থেমে থেমে বৃষ্টি চলছেই, পিছলে যাওয়া থেকে কোনোমতে রেহাই পেলাম বেশ কয়েকবার। জোঁকে ধরার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও দু-এক স্থানে গাছের ডাল ধরে পিছলে পড়া ঠেকালাম। অবশেষে গ্রামের কাছে এসে স্বস্তি। মাত্র ৪-৫ ঘণ্টাতেই আমাদের যাওয়া-আসা শেষ! গাইড তো অবাক। তিনি বললেন এর আগে কোনো অভিযাত্রী দলকে নিয়ে তিনি ৮-৯ ঘণ্টার আগে ফিরতে পারেন নি। একবার তো দুই নারীসহ এক দলকে নিয়ে সারারাত পাহাড়ে থাকতে হয়েছিল। এর মধ্যে এক নারীকে কাঁধে করে আনতে হয়েছিল অনেকটা পথ। শেষে জোঁককে গায়ে নিয়েই ঢাকা ফিরেছিলেন সেই অভিযাত্রীরা। গাড়ির কাছে আসতেই দেখলাম ড্রাইভার নেই। শুনলাম তিনি খেয়ে-দেয়ে ঘুমাচ্ছেন। আমরা আসার খবর পৌঁছামাত্রই তিনিও অবাক হলেন, এত আগে ফিরে আসব সেটা তার ভাবনাতে ছিল না! যাই হোক গাড়িতে উঠে রওয়ানা হলাম। পথে পুকুর পেয়ে গাড়ি থামিয়ে সেখানে নেমে পড়লাম। সারা দিন ধরে ভেজা কাপড়ে আছি। এ অবস্থায় গোসল না করলেই নয়। পুকুরে গোসল সেরে আবার সেই ভেজা কাপড়েই গাড়িতে উঠলাম। সিটে বসার পর থেকেই একটু পর পর পা চুলকাচ্ছে। অবশেষে আবিষ্কার করলাম বাঁ পায়ে জোঁক ধরেছে। ভাগ্যিস মাত্রই ধরেছিল জোঁকটি, তাই কাঠি দিয়ে এটিকে সরাতে পারলাম। নয়তো স্থানীয় কোনো বাজারে নেমে লবণ দিয়ে ছাড়াতে হত। জোঁক ধরায় একদিকে ভালই হল। বিশেষ তেল গায়ে না মেখেই জোঁকের আস্তানা থেকে ঘুরে আসলাম অথচ তার সাথে মোলাকাত হল না- এমন হলে তো অভিযানেই অপূর্ণতা থেকে যেত!

Comments

Popular posts from this blog

হিন্দুবিদ্বেষী ছিলেন না সম্রাট আওরঙ্গজেব

নিউজ এক্সপ্রেস ডেস্ক: মুঘল সম্রাটদের মধ্যে কেবল একজনই ভারতীয়দের মধ্যে স্থান করে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন - তিনি আলমগীর আওরঙ্গজেব। সাধারণ মানুষের মধ্যে আওরঙ্গজেবের ইমেজ হলো একজন ধর্মীয় গোঁড়া ব্যক্তি হিসেবে , যিনি হিন্দুদের ঘৃণা করতেন আর যিনি নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে এমনকি নিজের বড় ভাই দারা শিকোকে পর্যন্ত রেহাই দেননি। তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি বৃদ্ধ পিতাকে আগ্রার একটি দুর্গে তার জীবনের শেষ সাড়ে সাত বছর বন্দি করে রেখেছিলেন। সম্প্রতি পাকিস্তানী নাট্যকার শাহীদ নাদিম লিখেছেন যে ভারত ভাগের বীজ সত্যিকার অর্থে সেদিনই বপন করা হয়েছিল , যেদিন আওরঙ্গজেব তার ভাই দারাকে পরাজিত করেছিলেন। জওহরলাল নেহরুও ১৯৪৬ সালের প্রকাশিত তার বই ‘ ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া ’ তে আওরঙ্গজেবকে একজন গোঁড়া ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তবে মার্কিন ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রাশকা তার বই ‘ আওরঙ্গজেব - দ্যা ম্যান অ্যান্ড দ্যা মিথ ’ বইয়ে লিখেছেন যে আওরঙ্গজেব হিন্দুদের ঘৃণা করতেন আর তাই মন্দির ধ্বংস কর

দাঁড়িয়ে পানি পান কি ঠিক?

নিউজ এক্সপ্রেস ডেস্ক : সময় কিংবা অভ্যাসের কারণে আমরা অনেকেই দাঁড়িয়ে পানি পান করি। কিন্তু এই অভ্যাসের মাধ্যমে আমরা ডেকে আনছি বিপদ। একটা নয়, একগুচ্ছ রোগ বাসা বাঁধছে শরীরে। ভুগতে হচ্ছে কিডনি সমস্যায়। শরীরে পানির গুরুত্ব অনেক। কিন্তু ভুল নিয়মে পানি, বিশেষ করে রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে ঢকঢক করে পানি পানের অভ্যাসে শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রোগ- এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। দাঁড়িয়ে পানি পানের কুফল শরীরে টক্সিনের পরিমাণ বাড়ে: পানি পানের পরেই শরীরের ছাঁকনিগুলো শরীরকে পরিশ্রুত করার কাজ শুরু করে। দাঁড়িয়ে পানি পান করলে শরীরের ভিতরে থাকা ছাঁকনিগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। পরিশ্রুত করার কাজ বাধা পায়। ফলে, শরীরে টক্সিনের মাত্রা বাড়তে থাকে। পাকস্থলীতে ক্ষত: দাঁড়িয়ে পানি পান করলে তা সরাসরি পাকস্থলীতে গিয়ে আঘাত করে। পাকস্থলী থেকে নিঃসৃত অ্যাসিডের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বদহজমের আশঙ্কা বাড়ে। তলপেটে যন্ত্রণাসহ একাধিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। আর্থারাইটিসের আশঙ্কা: দাঁড়িয়ে পানি পান করলে শরীরের মধ্যে থাকা কিছু উপকারী রাসায়নিকের মাত্রা কমতে থাকে। ফলে হাড়ের জোড়ায় কর্মক্ষমতা কমে যায়। সেখান থেকে আর্থারাইটিসের আশ

হরিণের রাজ্যে

শাহনেওয়াজ খান আমরা দশ-বারোজন মিলে চারদিক থেকে ঘিরে ধরলাম হরিণের পালটাকে। ৬০-৭০টা হরিণ হবে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে পালটাকে ঘিরে ধরেছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আলো দ্রুত কমে যাচ্ছে। শেষ সময়, সুতরাং সবাই চারদিক দিয়ে এক নিঃশ্বাসে দৌড় দিলাম হরিণের পালকে আটকাতে। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য! আমার দু’পাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে হরিণ। এত জোরে দৌড়াচ্ছে যে পায়ের নিচের খুড়ের অংশগুলো ঠিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। হরিণের ওপর ঝাঁপ দিয়ে পড়ার ইচ্ছেটা শুরুতেই তো বড় বড় শিং দেখে মারা গিয়েছিল। এখন দৌড় দেখে উল্টো চুপসে গেলাম। মনে মনে প্রার্থনা শুরু করলাম, হে আল্লাহ, শিং বা খুরের আঁচড় যেন গায়ে না লাগে। বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে, এটা সুন্দরবন বা বিদেশি কোনো সাফারি পার্কের দৃশ্য? না, এটা আমাদের গর্ব নিঝুম দ্বীপের গল্প। খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষগুলোর দ্বীপে যেখানে হরিণই চাঞ্চল্যের উৎস। তবে এই হরিণগুলো কিন্তু শুধু দ্বীপের পরিবেশকেই নয়, মানুষগুলোকেও ব্যস্ত রাখে। দল বেধে এসে নষ্ট করে দেয় ক্ষেতের ফসল। ২০০৯ সালের শুরুর দিকে শীত মৌসুমে গিয়েছিলাম নোয়াখালীর হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স