নিউজ এক্সপ্রেস ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছে আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাতিসংঘ। এ নিয়ে শুক্রবার আলোচনায় বসছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। শনিবার এ নিয়ে বৈঠকে বসবে আরব লিগ।
নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্য দেশের মধ্যে আটটি দেশ এই জরুরি অধিবেশন ডেকেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র রাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ছাড়াও বলিভিয়া, মিশর, ইতালি, সেনেগাল, সুইডেন, উরুগুয়ে রয়েছে। শুক্রবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় এই বৈঠক শুরু হবে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, এটা খুবই গভীর উদ্বেগের বিষয়। কারণ দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান ছাড়া এর (ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সঙ্কট) কোনো বিকল্প নেই।
রয়টার্স জানিয়েছে, গত বুধবার ট্রাম্পের ওই ঘোষণার পরপরই আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো এ সিদ্ধান্তকে ‘অস্থিরতা কবলিত অঞ্চলটিতে উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এর নিন্দা জানিয়েছে।
ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ওয়াশিংটন তার নেতৃত্বদানকারী ভূমিকার জলাঞ্জলি দিয়েছে। দেশটির ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল হামাস ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার শামিল’ বলে মন্তব্য করেছে। দলটির প্রধান ইসমাইল হানিয়া নতুন ‘ইন্তিফাদা’র (জাগরণ) ডাক দিয়েছেন।
ইসরায়েলে তেল আবিব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়ার ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। জেরুজালেম বিষয়ে কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত নীতি পাল্টে দেওয়া ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র দেশগুলোও।
ট্রাম্পের ‘একতরফা’ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে ফ্রান্স, পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি বজায় রাখারও আবেদন জানিয়েছে দেশটি। যুক্তরাজ্য বলেছে, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত শান্তি উদ্যোগের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখবে না এবং জেরুজালেমে ইসরায়েল ও ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব থাকা উচিত।
জার্মানি বলেছে, জেরুজালেমের মর্যাদা শুধু দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র আরব রাষ্ট্রগুলোও ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
এক বিবৃতিতে সৌদি আরব বলেছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা ‘অযৌক্তিক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’। আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইসরায়েলে সঙ্গে প্রথম শান্তিচুক্তি করা মিশর ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এতেও জেরুজালেমের আইনি মর্যাদা নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটবে না। মার্কিন এই পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশও।
জর্ডান বলেছে, পূর্ব জেরুজালেমের ওপর ইসরায়েলি দখলদারিত্বকে দৃঢ় করায় ট্রাম্পের পদক্ষেপ ‘আইনি বৈধতা হারিয়েছে’। লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন বলেছেন, জেরুজালেমের বিষয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত সঙ্কট সৃষ্টি করবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রচেষ্টার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। এই সিদ্ধান্তে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে আর তাতে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
ট্রাম্পের পদক্ষেপকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে মন্তব্য করেছে তুরস্ক। ট্রাম্পের এই ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটির সরকার। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় তুরস্কের ইস্তাম্বুলে যুক্তরাষ্ট্রের কন্স্যুলেটের বাইরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে কয়েকশ প্রতিবাদকারী। কন্স্যুলেট ভবনের দিকে কয়েন ও অন্যান্য বস্তু ছুড়ে মারে তারা।
ট্রাম্পের পদক্ষেপকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনে জাতিসংঘের দেওয়া প্রস্তাবের লঙ্ঘন অভিহিত করে এর ‘তীব্র নিন্দা’ করেছে ইরান। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে ইসরায়েলের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য যুদ্ধ শুরু করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের তীব্র বিরোধী, এটি পরিষ্কার করে দিন।’ ইরাকের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। একইসেঙ্গ দেশটিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে সরকার।
এছাড়া জেরুজালেমের মর্যাদা সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস। রাশিয়া ও চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করবে।
এসব প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘ইসরায়েলে প্রথম দিন থেকে এটি আমাদের লক্ষ্য ছিল, এটি শান্তির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’ ঘোষণার দিনকে ‘ঐতিহাসিক দিন’ বলেও অভিহিত করেছেন তিনি।
এর আগে মিত্রদের ডাক উপেক্ষা করে ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বুধবার দুপুরে হোয়াইট হাউসে কূটনীতিকদের অভ্যর্থনা কক্ষে এক ভাষণে ট্রাম্প বলেন, ‘জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির এটাই সময় বলে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দুই দশকেরও বেশি সময়ের ছাড় দিয়েও আমরা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারিনি।’
জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত বিলম্বিত করতে এতদিন বিশেষ আদেশে পররাষ্ট্র দপ্তরকে আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করে আসছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টরা। মঙ্গলবারও ট্রাম্প ওই আদেশে সই না করায় তিনি দীর্ঘদিনের রেওয়াজ উল্টে এই ঘোষণা দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তরে পররাষ্ট্র দপ্তরকে নির্দেশ দিচ্ছেন বলেও জানান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ই ‘দুই রাষ্ট্র’ সমাধান চাইলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সায় থাকবে।
১৯৪৮ সালে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই জেরুজালেমকে তাদের রাজধানীর স্বীকৃতি দিল। মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের কাছে পবিত্র নগরী জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে চায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ই। ট্রাম্পের এই ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় ‘মরণ ছোবল’ হবে বলে আগেই সতর্ক করেছিলেন ফিলিস্তিনের নেতারা।
(এসকে/ডিসেম্বর ০৭, ২০১৭)
Comments
Post a Comment